চালের কূটনীতি ও মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্ক

হারুনুর রশিদ

সংগৃহীত ছবি

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে বিরোধ থাকা সত্ত্বেও কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে চালের ব্যবহার বিশ্ব মিডিয়ায় কভারেজ পেয়েছে। রাজনীতিতে খাদ্যের প্রভাব নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। প্রাচীনকালে, অনেক রাজা তাদের অতিথিদের আপ্যায়ন করার জন্য খাবারকে কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন। আধুনিক রাজনৈতিক বিশ্বেও সেই ঐতিহ্য অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রনেতাদের অনেকে মিত্রদের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে বা বিরোধীদের সঙ্গে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য খাদ্য কূটনীতির ব্যবহার করছেন।

একটি ইংরেজি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য রাইস বা চাল একটি প্রিয় কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই পণ্যটি ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড এবং চীন ও ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর বেশির ভাগ মানুষের প্রধান খাদ্য। একটি দেশের বেঁচে থাকার জন্য কৃষি খাত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগত খাত। খাদ্য ছাড়া দেশ বিশৃঙ্খলা ও দেউলিয়া অবস্থা অনুভব করতে পারে। বাংলাদেশ সরকার চালের প্রাপ্যতা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করে। সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায় হলো চাল আমদানি করা। এই আমদানি নীতির কারণে অনেক ক্ষতি হয়, কারণ বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে বিরোধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট পরিস্থিতিতে চাল আমদানি ছাড়া বিকল্প নেই। এদিকে অনেক দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ মজুত বজায় রাখতে রপ্তানির দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এই কারণে বাংলাদেশ চাল আমদানিতে শেষ পর্যন্ত মিয়ানমারকেও বেছে নিয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষের জীবনে চাল একটি অপরিহার্য পণ্য। প্রতি বছর প্রায় ১ মিলিয়ন টন চাল আমদানি করা হয়। চাল-বাণিজ্যে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ২ লাখ টন সাদা চাল রপ্তানি করা হবে। প্রথম বারের মতো জানুয়ারি ২০২৩ সালে বাংলাদেশে সরাসরি ২ হাজার ৬৫০ টন চাল পাঠানো হবে। মিয়ানমারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সরকার-টু-সরকার চুক্তি অনুযায়ী, মিয়ানমার বাংলাদেশে দেড় লাখ টন সাদা চাল পাঠিয়েছে ২০২২ সালে। গেল বছরের ৮ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার ও বাংলাদেশ চাল বাণিজ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে। এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২২ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে মিয়ানমারের কাছ থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টন সাদা চাল এবং ৫০ হাজার টন সেদ্ধ চাল কিনতে সম্মত হয়েছে।

সমঝোতা স্মারক অনুসারে, বাংলাদেশের খাদ্য অধিদপ্তর এবং মিয়ানমার রাইস ফেডারেশন বাংলাদেশে রপ্তানি করার জন্য মিয়ানমারের ২ লাখ টন সাদা চালের বিক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বিক্রয় চুক্তি অনুযায়ী, মিয়ানমার ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ১৫ হাজার টন সাদা চাল রপ্তানি করেছে। অবশিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বিতরণ করা হবে।

চাল বাণিজ্যে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, মিয়ানমার রাইস ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে ৪৮টি কোম্পানি ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে চীনা ইউয়ান দিয়ে বাংলাদেশে ২ লাখ টন চাল রপ্তানি করবে। মিয়ানমার রাইস ফেডারেশন (এমআরএফ) জানিয়েছে, মিয়ানমার চলতি মাসে বাংলাদেশে ১ লাখ ৬০ হাজার টন চাল রপ্তানি শুরু করবে। এমআরএফের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশে চাল রপ্তানির জন্য জাহাজের আগমনের অপেক্ষা করছি। চলতি মাসেই বাংলাদেশে চাল রপ্তানি শুরু হবে।’ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি করা চাল ইয়াঙ্গুনের সুলে বন্দর, আইয়ারওয়াদ্দি অঞ্চলের পাথেইন বন্দর এবং আরাকান রাজ্যের সিত্তওয়ে বন্দর থেকে পরিবহনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

আরাকান স্টেট রাইস মিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, এমআরএফ দ্বারা সংগঠিত একটি কোটাব্যবস্থার অধীনে অঞ্চল ও রাজ্য থেকে ২ লাখ টন চাল কেনা হচ্ছে। আরাকান স্টেট রাইস মিলার্স অ্যাসোসিয়েশন এমআরএফ-এর কাছে ২২ হাজার ৫০০ টন চাল বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরাকান স্টেট রাইস মিলার্সের ভাইস-চেয়ারম্যান ইউ নি নি থান বলেছেন, কিউকতাওয়ের চারটি চালকল বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য এমআরএফ-কে রপ্তানি-মানের চাল সরবরাহ করবে এবং চাল রপ্তানি জানুয়ারিতে শুরু হবে।

আরাকান রাজ্যে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন একরেরও বেশি কৃষিজমি রয়েছে। কিন্তু আরাকান কৃষক ইউনিয়নের তথ্য অনুসারে, বিভিন্ন কারণের কারণে শুধু ৮ লাখ ৫০ হাজার একর ধান চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। এমআরএফ অনুসারে, মিয়ানমার ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ১০ লাখ টনের বেশি চাল এবং ভাঙা চাল রপ্তানি করেছে এবং ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করেছে।

মিয়ানমার ও বাংলাদেশ তাদের চালের কূটনীতির চর্চা শুরু করেছে। বাংলাদেশে মিয়ানমারের চাল সরবরাহ তাদের সম্পর্ক আরো গভীর করবে। বাংলাদেশি ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে এটি একটি মহৎ প্রচেষ্টা। এটি বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের জনগণের মধ্যে ভালো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কও গড়ে তুলবে। অল্প সময়ের মধ্যে, উভয় পক্ষের নতুন প্রজন্ম অর্থনীতি, পর্যটন ইত্যাদি ক্ষেত্রে আরো ভালো সম্পর্ক চায়। তারা রোহিঙ্গা শরণার্থী ও সীমান্ত সমস্যা উভয় পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পক্ষপাতী। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক অলৌকিকতায় পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রশংসিত হয়। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পিং-পং কূটনীতি তাদের সম্পর্ক শক্তিশালী করার জন্য স্থাপন করা হয়েছিল। আমরা চালের কূটনীতির মতো আরেকটি পিং-পং কূটনীতির প্রয়োগও আশা করতে পারি। চালের কূটনীতি সামান্য উদ্যোগ হলেও এর তাৎপর্য ব্যাপক। এই সামান্য উদ্যোগ উভয় পক্ষের জন্য একটি মহান অর্জনে পরিণত হবে। উচ্চ পর্যায়ের সরকারি সফর সম্পর্ক জোরদার করারও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে এটি। এর মাধ্যমে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে দুই প্রধানমন্ত্রী সফর বিনিময় করতে পারেন। এটি মিয়ানমার ও বাংলাদেশের জন্য একটি সুখবরই বটে।

লেখক : লন্ডনভিত্তিক বাংলাদেশি প্রবাসী ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার বিষয়ক পর্যবেক্ষক ও গবেষক
মালয়েশিয়ার প্রভাবশালী ‘দ্য সান ডেইলি’ থেকে অনুবাদ : মেহজাবিন বানু

শেয়ার করুন