হিমালয়ের বাতাসে কাঁপছে দেশ, জনজীবন বিপর্যস্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

শীতে বিপর্যস্ত জনজীবন
ফাইল ছবি

পৌষের তৃতীয় সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে শীত জেঁকে বসেছে। হিমালয়ের বাতাসে কাঁপছে পুরো দেশ। শীতের প্রকোপে কাবু রাজধানীবাসীও। শীতের কারণে দেশের হাসপাতালগুলোতে বেড়ে গেছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। শীতের সঙ্গে ঘন কুয়াশা মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তীব্র শীতে গ্রামগঞ্জে বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের অবস্থা কাহিল। ছিন্নমূল মানুষের অবস্থা আরও করুণ। সবচেয়ে বিপদে আছেন খেটেখাওয়া মানুষগুলো। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচলেও বিঘ্ন ঘটছে।

বুধবার (৪ জানুয়ারি) সকালে দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল কক্সবাজারের টেকনাফে ২৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগের দিন মঙ্গলবারও সকাল ৯টায় এখানে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমন কুয়াশা আরও দুই-তিন দিন থাকবে। তবে টানা হয়তো থাকবে না, দুপুরে কিছু কিছু জায়গায় রোদের দেখা মিলতে পারে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দিন ও রাতের তাপমাত্রা পার্থক্য কমে যাওয়ার কারণে দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি দেশের কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে কোথাও কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বুধবার জানান, দুটি কাক্সিক্ষত শর্ত পূর্ণ না হওয়ায় কুয়াশা কাটছে না। এর একটি হলো, পশ্চিমা লঘুচাপের ফলে বৃষ্টি হচ্ছে না। আরব সাগর থেকে আর্দ্রতা বহন করে নিয়ে এসে এ বৃষ্টি হয়। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হলে তাতে জলীয় বাষ্প চলে যায় এবং কুয়াশা দূর করতে পারে। এতে রাতের তাপমাত্রা কমে গেলেও দিনের তাপ বাড়ে।

দ্বিতীয়ত, ওপরের বাতাসের (জেট উইন্ড) নিম্নগামী হওয়া। সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে ১২ থেকে ১৮ হাজার ফুট ওপর দিয়ে এ হাওয়া বয়ে যায়। ঘণ্টায় এটি ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায়। এটি নিচে নেমে এসে প্রচণ্ড বাতাস সৃষ্টি করলে তার ধাক্কায় জলীয় বাষ্প সরে যায়। কিন্তু সেটিও এখন হচ্ছে না। তাই কুয়াশাও কাটছে না।

এখন যে কুয়াশা হচ্ছে, তা স্থানীয়ভাবে সৃষ্টি ও তা তাপমাত্রার তারতম্যের জন্যই হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. আবদুর রহমান খান। তিনি বলেন, এর আরেকটি উৎস হচ্ছে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বয়ে আসা কুয়াশা। এটি পুরো গঙ্গা অববাহিকা দিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস অনুযায়ী, ডিসেম্বরে সারাদেশে গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। জানুয়ারিতেও দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকতে পারে। তবে দেখা যেতে পারে শৈত্যপ্রবাহ।

চরম দুর্ভোগে ছিন্নমূল ও দিনমজুর

আমাদের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, জেলাজুড়ে বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। গ্রাম ও শহরে শীতার্ত মানুষদের দিন ও রাতে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের দৃশ্য চোখে পড়ছে। প্রতিদিনই বিকাল হলে শীতের তীব্রতা বেড়ে যায়। পরদিন দুপুর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকছে। শীতের কারণে সবচেয়ে বেশি ছিন্নমূল ও দিনমজুররা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। প্রচণ্ড শীতে কাবু চা বাগান ও হাওর তীরের মানুষসহ নিম্ন আয়ের মানুষ। গেল কয়েক দিন থেকে প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে জেলার চা শ্রমিক ও হাওরের বোরো চাষিরা মাঠে কাজ করছেন। প্রচণ্ড ঠান্ডা থাকায় ভরা মৌসুমে বোরো চাষের শ্রমিক সংকট চলমান রয়েছে।

জেলাজুড়ে মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুগুলোও প্রচণ্ড ঠান্ডায় কাবু হয়ে পড়েছে। ঠান্ডা বেড়ে চলায় বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষজন। শীতের প্রভাবে কাজ কর্ম অনেকটা কমে যাওয়ায় আয় রোজগার নিয়ে তাদের চরম দুশ্চিন্তা। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন হাওর তীরের বোরো চাষিরা। তীব্র শীতের মধ্যেও তারা ধানের চারা রোপণ ও পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকছেন। জেলাজুড়ে দেখা দিচ্ছে ঠান্ডাজনিত রোগবালাই। জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা কেবল বাড়ছেই। ঠান্ডাজনিত রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু ও বয়স্করা। প্রতিটি হাটবাজারে গরম কাপড়ের দোকানগুলোতে ভিড় বাড়ছে ক্রেতাদের। মৌলভীবাজার জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতালসহ শীতজনিত রোগে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে শিশু ও বয়স্কদের নিয়মিত ভর্তি অব্যাহত রয়েছে।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলস্থ আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জানান, বুধবার সকাল ৯টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত মঙ্গলবার ছিল ৮ দশমিক ৫ ও গত সোমবার তাপমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জেলার ওপর দিয়ে এখন মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইছে। তিনি জানান, আগামী কয়েকদিন তাপমাত্রা এ ধরনের থাকতে পারে। ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এ অঞ্চলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি।

হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে শীতজনিত রোগী

দেশের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষ করে শীতের ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

আমাদের নীলফামারী, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, নীলফামারী সদর হাসপাতালে আসন সংখ্যার দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগী বেশি। নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. গোলাম রসুল রাখি বলেন, ‘শীতের কারণে নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। পাশাপাশি যাদের হাঁপানি বা অ্যাজমা আছে তাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু ও বৃদ্ধরা।’

কুড়িগ্রামেও শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা। শয্যা-সংকটে ওয়ার্ডের মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। প্রায় একই অবস্থা দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ হাসপাতালের।

কুয়াশার কারণে বিমান চলাচলে বিঘ্ন

ঘন কুয়াশার কারণে বুধবার সাতটি ফ্লাইট ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দেরিতে উড্ডয়ন করেছে এবং একটি ফ্লাইট যথাসময়ে অবতরণ করতে পারেনি।

ঢাকা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জানান, রিয়াদ থেকে আসা সৌদি এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট সকাল সাড়ে ৭টায় ঢাকায় অবতরণ করার কথা ছিল। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে সেটি ওই সময় নামতে পারেনি। ফ্লাইটটি ভারতের হায়দরাবাদে গিয়ে নেমেছে। পরে আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি হলে ফ্লাইটটি ঢাকায় ফিরে আসে। অন্যদিকে কুয়াশার কারণে সাতটি ফ্লাইট উড্ডয়নে বিলম্ব হলেও কোনো ফ্লাইট বাতিল হয়নি।

বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, সকালে জাজিরা এয়ারলাইনস, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস, এয়ার অ্যারাবিয়া, ফ্লাই দুবাই, কাতার এয়ারওয়েজ, ওমান এয়ার এবং ইন্ডিগো এয়ারলাইনসের ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ে উড়তে পারেনি। ফ্লাইটগুলো এক-দেড় ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে।

শেয়ার করুন