শিক্ষার্থীদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বারবার ‘ব্যর্থ’ হওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ দেখছেন না শিক্ষাবিদরা। এনসিটিবি কেন একই ভুুলের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না, এবারও কেন পারলো না তথ্যবিভ্রাট মুক্ত পাঠ্যবই ছাপাতে, জাতির আগামীর ভবিষ্যতের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব বিবেচনায় ওই প্রশ্নের উত্তর জানার সঙ্গে ‘সমস্যার’ সমাধানও জরুরি।
উচ্চ আদালতের নির্দেশ, শিক্ষাবিদদের সমালোচনা ও অভিভাবকদের ক্ষোভের পরও এনসিটিবি ‘যেই লাউ, সেই কদুর’ অবস্থানে আছে। চলতি শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইও ভুলভ্রান্তি ও অশুদ্ধ বানানে ভরা। আওয়ামী লীগের সরকার ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি উৎসব আয়োজন করে প্রথম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরকে বিনামূল্যে বই দেয়। দেশ-বিদেশে বহুল প্রশংসিত সরকারের এ কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় এবারও খ্রিষ্টীয় বছরের প্রথমদিন বই উৎসবের আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব বইয়ের মধ্যে ঐতিহাসিক কিছু তথ্যে অসঙ্গতি ও বিভ্রান্তি আছে। কোনো কোনো শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে গত শিক্ষাবর্ষে থাকা ভুল তথ্য এবারও রয়ে গেছে।
মত ও পথের সহযোগী বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন সংবাদমাধ্যম ও টিভি চ্যানেলে পাঠ্যবইয়ে থাকা বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। আমাদের পর্যালোচনা বলছে, সবচেয়ে বেশি তথ্যবিভ্রাট হয়েছে দেশের ইতিহাস, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু ও জাতির শ্রেষ্ঠ অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখায়। পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্য থাকার বিষয়টি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। দুঃখজনক ও লজ্জাকর। যে ঘটনা দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়, যাঁর নেতৃৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, সেসব ও তাঁকে নিয়ে ভুল ইতিহাস চর্চার ও শিক্ষার্থীদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভুল শেখানোর কোনো সুযোগ নেই বলেই আমরা মনে করি।
সহযোগী একটি দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের রচয়িতারা সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের কথা বলতে গিয়ে তথ্যগত ভুলের সঙ্গে বিষয়টিকে অহেতুক জটিল করে তোলেছেন। ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ বলে রাষ্ট্রপিতা (ফাউন্ডিং ফাদার অব দ্য নেশন) বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নতুন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করান। অথচ বইয়ে লেখা হয়েছে, বিচারপতি মোহাম্মদ সায়েম শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন।
একই বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যা’বিষয়ক অংশের প্রথম লাইনে বলা হয়েছে, ‘২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল।’ প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাল রাতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়।
নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ২২ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার, মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি। প্রকৃত ইতিহাস হলো, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
পাঠ্যবইয়ে এ ধরনের অমার্জনীয় ভুল আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে। কারণ, পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্য থাকলে শিক্ষার্থীরা ভুল শিখবে। ভুল ইতিহাসের চর্চা একটা প্রজন্মকে পিছিয়ে দেয়, এমনকি কখনো কখনো একটা প্রজন্মকে ধ্বংসও করে দিতে পারে। অনেক সময় অনিচ্ছাকৃত ভুল তথ্য পরিবেশনের কারণে আর তা ব্যাপক প্রচার পাওয়ায় ঐতিহাসিক ঘটনার তথ্য বিকৃত হয়ে যায়। অর্থনৈতিকভাবে দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। তথ্যপ্রযুক্তিতেও দেশ পিছিয়ে নেই, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছে। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনে এসবের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেবে।
এর আগেই মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলতে হবে। সেজন্য দরকার ;তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা। আমরা মনে করি, বই লেখা ও সম্পাদনায় পেশাদারত্বের ঘাটতির কারণে এবং ভুল তথ্য রোধে শক্তিশালী কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় নতুন পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসের তথ্য বিভ্রাট থেকে গেছে। পাঠ্যবইয়ে যেসব ভুল তথ্য আছে, জরুরি ভিত্তিতে সেগুলো সংশোধন করার আমরা জোর দাবি জানাই।