ফেলানী হত্যার এক যুগ : বিচারের আশায় দিন গুনছে বাবা-মা

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি

ফেলানী হত্যা
ফাইল ছবি

‘আমার মেয়ে ফেলানীকে মেরে কাঁটা তাঁরে ঝুলায়ে রাখছিল বিএসএফ। আমি যেমন আমার মেয়ের জন্য ১২টা বছর ধরে কাঁদছি, আর যেন কোনো সন্তানের মা এভাবে না কাঁদে।’ এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মৃত ফেলানীর মা জাহানারা বেগম।

কুড়িগ্রাম সীমান্তে কিশোরী ফেলানী হত্যার এক যুগ আজ শনিবার (৭ জানুয়ারি)। দেশ-বিদেশে আলোচিত এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও আজও বিচার পায়নি এই পরিবার।

universel cardiac hospital

জাহানারা বেগম বলেন, আমি চাই দুই দেশের সরকার মিলে আমার মেয়ে হত্যার বিচারটা করুক। বিচারটা হলে আমার আত্মা শান্তি পাবে। আমার সরকারের কাছে দাবি কোনো মা যেন আর সন্তান জন্য এভাবে না কাঁদে।

ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম বলেন, আমার চোখের সামনে বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ আমার মেয়েকে হত্যা করেছে। আমি অমিয় ঘোষের ফাঁসি চাই। দু’দেশের সরকার যেন সঠিক বিচারটা করে। মেয়ে হত্যার ১২ বছর হলে গেল এখনো বিচার পেলাম না। রাত দিন ২৪ ঘণ্টা মেয়ের জন্য কাঁদি। দুইবার বিচারের জন্য ঢেকে নিয়ে গেছে কোনো লাভ হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কেঁদে কেঁদে বিচার চাইছি। আমার নাবালক মেয়েটারে ভারতীয় বিএসএফ অমিয় ঘোষ অনেক কষ্ট দিয়া মারছে। এখনো বিচার পাইলাম না, তার কী বিচার দুনিয়ায় নাই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিচারিক কাজ ভারতের উচ্চ আদালতে ঝুলে থাকায় এখনও ন্যায় বিচারের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুণছেন ফেলানীর বাবা-মা। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বাবার সঙ্গে কাটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয় বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানী খাতুন। ফেলানীর মরদেহ কয়েক ঘণ্টা কাটাতারে ঝুলে থাকার দৃশ্য দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমসহ মনবাধিকার কর্মীদের মাঝে সমালোচনার ঝড় তোলে। পরে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারের বিএসএফ’র বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যার বিচার কাজ শুরু হয়। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয় বিএসএফ’র বিশেষ আদালত।

বিজিবির আপত্তিতে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনঃবিচার শুরু হলেও সেখানে খালাস দেওয়া হয় অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে। এরপর ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই ভারতীয় মানবাধিকার সুরক্ষা (মাসুম) এর মাধ্যমে ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। পিটিশনের ভিত্তিতে কয়েক দফায় শুনানির দিন পিছালেও এখনও আদালতেই ঝুলে আছে পিটিশনটি। এ অবস্থায় হতাশার মধ্যে থাকলেও মেয়েকে হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি চায় ফেলানীর পরিবার।

বিচার চেয়ে মৃত ফেলানীর ছোট ভাই জাহান উদ্দিন বলেন, ১২ বছর হলে গেল আমার বড় বোন হত্যার বিচার পেলাম না। ফেলানী আপু আমাদের যে কত আদর যত্ন করত ভুলতে পারি না। যার বোন হারিয়েছে সেই শুধু বলতে পারবে বোন হারানোর কষ্ট কী। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন আমার বোনকে যে মারছে তার যেন সঠিক বিচারটা হয়।

নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলনিটারী গ্রামের ফেলানীর পরিবারের প্রতিবেশী আমিনুল ইসলাম ও আব্দুল খালেক বলেন, ফেলানী হত্যার বিচার পেতে আদালতে স্বাক্ষী দিতে কয়েক দফায় ভারতে যান ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিচার না পাওয়াটা দুঃখ জনক। ফেলানী হত্যার বিচারের পাশাপাশি সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবি জানাই।

কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর ও ফেলানীর বাবার আইনি সহায়তাকারী অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে ভারতের সুপ্রিম কোটে দাখিল করা রিট পিটিশনটির শুনানি এখনও শুরু হয়নি। বিলম্ব হলেও ন্যায় বিচারের মাধ্যমে দু’দেশের বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্ক ও শান্তিপূর্ণ সীমান্ত প্রতিষ্ঠা হবে।

নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলনিটারী গ্রামের নুর ইসলাম ও জাহানারা দম্পতির ৮ সন্তানের মধ্যে সবার বড় মেয়ে ছিল ফেলানী। পরিবারের অভাব অনটন দূর করতে কাজের সন্ধানে সপরিবারে চলে যান ভারতে। মেয়েকে বিয়ে দিতে দালালের মাধ্যমে দেশে ফেরার সময় বিএসএফের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ফেলানী।

শেয়ার করুন