সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে সাংবাদিকদের ‘ক্রীতদাস’, ‘দালাল’ ও ‘গরু-ছাগল’ বলে সম্বোধন করলেও দেশে ফিরেই সাংবাদিকদের ভূমিকা নিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন গণ-অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব এবং ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। গত সোমবার (৯ জানুয়ারি) সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরার আগে সাংবাদিকদের এমন মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
১১ জানুয়ারি (বুধবার) সংবাদ সম্মেলনে লাইভের বক্তব্য নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে কোনো দুঃখ প্রকাশ না করে তিনি বলেন, ‘আমার আজকের উত্থানের পেছনে গণমাধ্যমের একটি বড় ইতিবাচক ভূমিকা ছিল।’
সৌদি আরব থেকে দেয়া লাইভে অবশ্য সাংবাদিকদের প্রতি এত ভালোবাসা প্রকাশ করেননি নুর। উল্টো তাদের ক্রীতদাস, দালাল এবং হাটে বিক্রির গরু-ছাগল বলে সম্বোধন করেন তিনি। সেই লাইভে নুর বলেন, ‘বিদেশি পত্র-পত্রিকায় লেখা হচ্ছে বাংলাদেশ দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। আর তারা (সরকার) তাদের ক্রীতদাস সাংবাদিকদের দিয়ে এ গুজব ও প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে।’
বিদেশি কোন পত্র-পত্রিকায় ‘বাংলাদেশ দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে’ বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করেননি তিনি। এদিকে এমন কোনো খবর মেলেনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
ফেসবুক লাইভে সাংবাদিকদের ‘দালাল’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করে নুর বলেন, ‘আপনারা যে দালালিটা করলেন, এটা কি কোনো নীতিমালার মধ্যে পড়ে? এগুলো একেবারেই ক্রীতদাসের সাংবাদিকতা। রাজনীতির মাঠে গরু-ছাগলের মতো সাংবাদিকরা বিক্রি হচ্ছে। এভাবে বিক্রি হবে তা আমরা আশা করিনি।’
অন্যদিকে দেশে ফিরেই বুধবার সাংবাদিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নুর বলেন, ‘আমি মিডিয়াকে এভয়েড করতে চাই না, মিডিয়াকে আমি সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করি, সম্মান করি। আমার আজকের উত্থানে আমি মনে করি গণমাধ্যমের একটি বড় ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। এ কৃতজ্ঞতার কারণে আমি গণমাধ্যমের প্রতি সবসময় সহনশীল থাকি।’
অবশ্য নুরের এমন দ্বিচারিতা নতুন কিছু নয়। নেতৃত্ব লাভের শুরু থেকেই তিনি বিভিন্ন সময় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করার কারণে সমালোচিত হয়েছেন। ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পর্যায়ের আলোচনায় আসেন তিনি। নির্বাচনের আগমুহূর্তে কারচুপির অভিযোগ এনে তা প্রত্যাহারের কথা বলেন নুর। তৎকালীন প্রশাসনের অধীন ভোটে যাবেন না বললেও শেষমেশ নির্বাচনে অংশ নেন তিনি।
ভোট শেষে তিনি শুরু করেন বিতর্কিত আচরণ। সে সময়ের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, নির্বাচনে স্বল্প ব্যবধানে তিনি ও তার প্যানেলের একজন জয়লাভ করলে নুর দায়িত্ব নেবেন না বলে জানান। নিলেও পুনর্নির্বাচনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলবেন। ওই সময় এক দিনে পাঁচবার পাঁচ ধরনের বক্তব্য দিয়েও সমালোচিত হন নুর। এমনকি তার আহ্বানে বিজয়ী কয়েকজন পদত্যাগও করেন। তবে নুর পদ আঁকড়ে থাকেন ও অবশেষে তিনি দায়িত্ব নিয়ে সেই মেয়াদ পূর্ণ করেন।
এর আগে বুধবার দেশে ফিরে জামায়াত নেতাকে ‘মানবতাবাদী লোক’ বলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন নুরুল হক নুর। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জঙ্গিবাদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার অপরাধে গ্রেফতার জামায়াতে ইসলামের আমিরের প্রসঙ্গ তুলে তাকে ‘মানবতাবাদী লোক’ হিসেবে অভিহিত করেন। এ সময় তিনি নিজের নিরাপত্তা হুমকির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘জামায়াতের আমিরের মতন একজন মানবতাবাদী লোককেও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যারা জেলে নিতে পারে, আমাকে নেয়া তো তাদের জন্য কোনো ব্যাপার না।’
উল্লেখ্য, জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানকে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ গ্রেফতার করে। এর আগে সরাসরি জঙ্গিদের সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রেফতার করা হয় তার ছেলে চিকিৎসক রাফাত সাদিক সাইফুল্লাহকে। ছেলে জঙ্গি ট্রেনিংয়ের জন্য হিজরত করে এবং তার ছেলে একটা গ্রুপসহ বান্দরবানের পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা করে যেতে না পেরে শফিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরবর্তী সময়ে জামায়াতের আমির তাকে (ছেলেকে) নিরাপদে ফিরিয়ে আনার সব ব্যবস্থা করেন। এই সবকিছু প্রমাণিত এবং শফিকুর রহমান এসব কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু তার জঙ্গি সম্পৃক্ততাকে নুর ‘জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ’ এবং মুক্তিযুদ্ধকালে যুদ্ধাপরাধ করা এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কার্যক্রমে জড়িত জামায়াত নেতাকে ‘মানবতাবাদী লোক’ হিসেবে অভিহিত করে নুর, যা স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে, তিনি দেশের মৌলবাদী ডানপন্থি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে যাচ্ছেন।
হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ নিয়ে তার প্রধান সহযোগী তারেকের সাম্প্রদায়িক মন্তব্য প্রসঙ্গেও ক্ষমা না চেয়ে সংবাদ সম্মেলনে নুর জানান, এত আগের একটি বিষয় নিয়ে এখন আলোচনা কেন?
কিন্তু এ ধরনের সাম্প্রদায়িক মন্তব্য কোনো সময়েই করা উচিত কি না বা ভুল করে এমন মন্তব্য করায় তিনি বা তার সহযোগীরা দুঃখিত কি না, এ বিষয়ে কিছুই বলেননি নুর।