সমাজে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ভয়ের আবহ প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। প্রতি মাসে সরকারি লোকজন গড়ে চারটি করে মামলা করছেন এ আইনে। গত চার বছরের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগই বেশি হয়েছে।
আজ শনিবার ‘কী ঘটছে: বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ব্যবহারপ্রবণতা ও নিদর্শন’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আলোচকেরা এসব মত তুলে ধরেন। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ওয়েবিনারের আয়োজন করে।
ওয়েবিনারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা, অভিযুক্ত, আটক, আটক ব্যক্তিদের পরিচয় ও মামলাকারীদের পরিচয়সংক্রান্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ডিস্টিঙ্গুইশড অধ্যাপক ও সিজিএসের উপদেষ্টা আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ভীতির পরিবেশ তৈরি করাই ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেন সবাই সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকেন, প্রতিবাদ না করেন।
ওয়েবিনারে আলোচকেরা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ আইনে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। প্রয়োজনে ১৫ দিন সময় বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ৭৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে না। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিচারের আগেই দীর্ঘদিন আটক থাকেন। গত ৪ বছরে ১৮ বছরের কম বয়সী অন্তত ২৬ কিশোর এ আইনে অভিযুক্ত হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীন ৪ বছরে ১ হাজার ১০৯টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে বলে ওয়েবিনারে জানানো হয়। এসব মামলায় অভিযুক্ত ২ হাজার ৮৮৯ জন। এর মধ্যে আটক হয়েছেন ১ হাজার ১১৯ জন, অর্থাৎ মোট অভিযুক্ত মানুষের ৩৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ আটক হয়েছে। তবে এ তথ্য মামলার পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মামলার তথ্য প্রকাশ করতে চায় না।
আলোচকেরা বলেন, ফেসবুকে জনগণের কণ্ঠস্বর নীরব করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হয়েছে। মাসে গড়ে ৯টি মামলা হয়েছে ফেসবুকে মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে। মোট ৬৯৮টি মামলা হয়েছে ফেসবুককেন্দ্রিক। এর মধ্যে হয়রানির মামলা ৭৬টি, আর্থিক প্রতারণা ৪৪টি এবং ধর্মীয় অবমাননার ১১৫টি মামলা। বাকি ৪৬৩টি রাজনৈতিক মামলা বলেই প্রতীয়মান হয়।
আলোচকেরা বলেন, সাংবাদিকদের জন্য খড়্গ হয়ে এসেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। বিশেষ করে আঞ্চলিক সাংবাদিকেরা বেশি ঝুঁকিতে। ২০২০ সালে এ আইনের অধীন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে। প্রতি মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের লোকজন গড়ে চারটি করে মামলা করেছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এ আইনের ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫ ধারায় মামলা বেশি হয়েছে। ২৫ ও ৩১ ধারা দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে আদালতও প্রশ্ন তুলেছিলেন।
আলোচনায় গ্লোবাল টিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যায়, গত চার বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগ হয়েছে বেশি। জামিন-অযোগ্য ধারার নিবর্তনমূলক ব্যবহার বেশি হয়েছে। প্রগতিশীল গোষ্ঠী এ আইনে বেশি আক্রান্ত হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে অবিলম্বে বাতিল করার দাবি জানান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব লর জ্যেষ্ঠ প্রভাষক সাইমুম তালুকদার। তিনি বলেন, জনগণের অধিকার রক্ষায়, নাকি দমন-পীড়নের জন্য এ আইন হয়েছে, সে প্রশ্ন উঠবেই। বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে নতুন করে আইন করতে হবে। এই আইনে প্রয়োজনীয় অনেক সংজ্ঞাই নেই।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে একটি মন্দ আইন বলে মন্তব্য করেন সাংবাদিক মাসুদ কামাল। তিনি বলেন, সর্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল এ আইনের উদ্দেশ্য। পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও মন্ত্রীদের মতো সমাজের একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এ আইনের প্রয়োগ দেখা যায় না।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এলিনা খান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। একসময় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার অপব্যবহার হয়েছে, সেটারই নতুন আকার পেয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। পরিসংখ্যান বলছে, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক—সবাই ঝুঁকিতে আছেন।
ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও বাক্স্বাধীনতার সংকট রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে যে ভয়ের আবহ, তা আরও প্রতিষ্ঠিত করেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। অধিকাংশ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকছেন।
সভাপতির বক্তব্যে সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ভয় সৃষ্টিতে সফল হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। রাজনৈতিকভাবে যারা শক্তিশালী, তাদের বিরুদ্ধে এ আইনের প্রয়োগ দেখা যায় না।