কৃষিশুমারি : প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিই অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র

ড. মিহির কুমার রায়

বাংলাদেশের কৃষি
ফাইল ছবি

কৃষি বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদনে তথা গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস হওয়ার কারণে। ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩.৪৭ শতাংশ, ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী শ্রমশক্তির ৪০.৬২ শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত বিধায় কৃষি এখনো নিয়োগের বড় ক্ষেত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে বিশেষত করে বৈশ্বিক মন্দার কারণে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি এড়াতে। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক রূপান্তর হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি), বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেশের চরম দারিদ্র্য ২০১৯-২০ সালে ১০ শতাংশ নিরসনে কৃষি উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে ইতিমধ্যে দানাদার ফসলের উৎপাদন সাড়ে ৪ কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ৪ কোটি ৭০ লাখ টন প্রায়। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ধান, গম, ভুট্টাসহ দানাদার ফসলের উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৫৫ লাখ টন। এছাড়া কন্দাল ফসলের (আলু, শাকসবজি, পাট ইত্যাদি) উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৯৭ লাখ টনের বেশি। গত ১১ বছরে পরিবারের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে কৃষক পরিবারের সংখ্যাও। ২০০৮ সালে মোট পরিবার ছিল ২ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার ৭৬৩টি। এর মধ্যে কৃষক পরিবার ছিল ১ কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৩টি। এতে দেখা যায়, বৃহৎ পরিবারগুলো দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে। ফলে পারিবারভেদে কৃষিজমির পরিমাণও কমছে। এতে মাঝারি ও বৃহত্ শ্রেণির কৃষক পরিবারের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ছোট কৃষক পরিবারের হাতেই এখন দেশের কৃষি। পরিবারগুলো যত ভাঙছে, জমি ততই ক্ষুদ্রাকৃতির হচ্ছে। এটাই বাস্তবতা। বড় ও মাঝারি কৃষক পরিবার ছোট হচ্ছে, ছোটরা আরো ছোট হচ্ছে। দেশে দিনে দিনে বাণিজ্যিক কৃষি খামার গড়ে উঠছে, ছোট কৃষক ছোট হতে হতে যখন একেবারেই ভূমিহীন হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা বাণিজ্যিক কৃষির আওতায় চলে আসছে।

universel cardiac hospital

ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের হার বাড়বে এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ বাবার যদি বেশি সন্তান থাকে, তাহলে সেই জমি তাদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এতে যিনি মাঝারি ছিলেন, তিনি ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছেন। আবার যিনি বৃহত্ ছিলেন, তিনি মাঝারি পর্যায়ে চলে আসছেন। এতে পরিবারের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের হারও বাড়ছে। সরকার উৎপাদনশীলতার দিকে জোর দিচ্ছি। যেখানে বছরে এক ফসল ছিল, সেখানে দুই ফসল এবং যেখানে দুই ফসল ছিল, সেখানে তিন ফসল চাষের ব্যবস্থা হয়েছে। অনেক কৃষক তার জমিতে বছরে পাঁচটি ফসলও করছেন। কারণ খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। এতে মাটিতে একধরনের প্রভাব পড়বে এটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে জৈব উপাদানগুলো কমে যাবে। সরকার প্রতি উপজেলায় সার ব্যবহারের নির্দেশিকা দিয়েছে এবং মাটির গুণাগুণ কীভাবে ঠিক রাখতে হয়, সে বিষয়েও পরিকল্পনা রয়েছে।’

প্রাচীনকাল থেকেই দেশের কৃষি খাত টিকিয়ে রেখেছেন প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকেরা। বড় পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ায় বড় ও মাঝারি শ্রেণির কৃষক পরিবারগুলো দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছেই কৃষকের পরিপূর্ণ তথ্য নেই। কিছু কিছু মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কাছে কৃষকের তথ্য থাকলেও সেটি পূর্ণাঙ্গ নয়। খোদ কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছেই প্রান্তিক কৃষকের সঠিক ডাটাবেজ নেই। সঠিক ডাটাবেজ না থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রান্তিক কৃষকের কৃষিঋণের সুবিধা প্রদান কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝে কৃষকের ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সম্পন্ন হয়নি এখনো। ফলে উচ্চমূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক দুর্দিনেও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইতিবাচক বিষয় হলো, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে প্রান্তিক কৃষকের ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দ্রতই এ কাজ সম্পন্ন করা দরকার। একই সঙ্গে কৃষকের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতাও নিশ্চিত করতে হবে।

করোনার সংকটকালে সবচেয়ে বেশি ভরসা জুগিয়ে গেছে কৃষক। মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষককে আহত করলেও কাবু করতে পারেনি। ২০২০-২১ সালে দুই দফার বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সামলে আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন অনাদিকালের সেই কৃষক। লকডাউনের মধ্যেও যে মানুষ কষ্টে হলেও খেতে পেয়েছে, সেটা তাদেরই কৃতিত্ব। বাংলাদেশে করোনাকালে খাদ্য উৎপাদন বহাল অবস্থায় ছিল, তার কৃতিত্ব বৃহত্তর কৃষক সমাজের। সরকার প্রতি বছর বিভিন্ন ফসলের ওপর ঋণদান কার্যক্রম হাতে নেয়। তবে বিশেষ করে কিছু ঋণ আছে ভর্তুকি পর্যায়ের, কিছু ঋণ আছে বাণিজ্যিক। ফসলের ঋণ কৃষক ফসল ঘরে তুললেই পরিশোধ করতে হয়। আর বাণিজ্যিক ঋণ প্রথাগত নিয়মেই বিতরণ করে থাকে ব্যাংকগুলো। তবে ভর্তুকি ঋণের হিসাবটা অবশ্যই আলাদা। দেশের স্বার্থে সরকার প্রতি বছর বিশেষ কিছু ফসলের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করে থাকে। তার মধ্যে মসলা, ডাল ও দুগ্ধজাত গাভির জন্য এই ঋণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রান্তিক কৃষকের সঠিক তথ্য-উপাত্ত না থাকায় কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে। এখন কৃষক শুধু খাওয়ার জন্যই পণ্য উৎপাদন করে না, তার অনেক বাজারসংক্রান্ত তথ্য প্রয়োজন। কৃষকের শুধু উৎপাদন উপকরণেরই প্রয়োজন হয় না, তার জীবন ধারণের জন্য অর্থেরও প্রয়োজন। এর জন্যও পূর্ণাঙ্গ তথ্য-উপাত্ত খুবই জরুরি।

দেশের কৃষকসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ দেশের উন্নয়নের মূল স্রোতের বাইরে পড়ে আছে এবং এই শ্রেণির মানুষের জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। বিশেষ ভর্তুকি ও প্রণোদনার যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রকৃত প্রান্তিক কৃষকের ডাটাবেজ তৈরি করে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করবে, ঐ ডাটাবেজ অনুযায়ী বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃত কৃষক চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ দেবে, ব্যাংকিং সেবাকে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। এজন্য ঋণের আবেদন প্রক্রিয়া সহজ করাসহ হাটবাজারে প্রকাশ্যে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যেখানে কৃষির উৎপাদন বাড়াতে কৃষককে নানা সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে কৃষকের প্রকৃত তালিকা প্রণয়ন জরুরি, যা দ্রুতই কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। প্রান্তিক কৃষকের তালিকা প্রণয়নের সময় যাতে কোনো ধনী কৃষক অন্তর্ভুক্ত না হন, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। তাহলেই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকেরা স্বাবলম্বী হবে এবং দেশ স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাবে।

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক, ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

শেয়ার করুন