২০০২ সালে সংঘটিত গুজরাট দাঙ্গা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল (ফাইল ছবি)
দুই দশক আগে ভারতের গুজরাটে সংঘটিত দাঙ্গায় দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির একটি ডকুমেন্টারিকে ‘প্রোপাগান্ডা’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
২০০২ সালে সংঘটিত গুজরাটের সেই দাঙ্গা মোদির নেতৃত্বকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০২ সালে যখন ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় তখন রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ভয়াবহ সেই দাঙ্গায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন, যাদের বেশিরভাগই মুসলমান। মূলত হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি ট্রেনে আগুন লেগে ৫৯ জন নিহত হওয়ার পর সহিংসতা শুরু হয়েছিল।
আল জাজিরা বলছে, বিবিসির ডকুমেন্টারিতে দেখানো যুক্তরাজ্যের তদন্তের প্রতিবেদনটিতে দাঙ্গার ঘটনাকে ‘পদ্ধতিগত সহিংসতা’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই সহিংসতায় ‘জাতিগত নির্মূলের সকল বৈশিষ্ট্য’ রয়েছে এবং নরেন্দ্র মোদির ওপর সরাসরি দায় চাপানো হয়েছে।
তদন্তের তথ্য ডকুমেন্টারিতে প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ওই প্রতিবেদনটি কখনোই প্রকাশ করা হয়নি।
মঙ্গলবার প্রকাশিত বিবিসি ওই ডকুমেন্টারি অনুসারে, ব্রিটিশ তদন্ত দল দাবি করেছে- দাঙ্গার সময় মুসলমানদের ওপর টার্গেট করে সহিংসতা বন্ধ করার জন্য পুলিশকে কাজ করতে বাধা দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এমনকি সূত্রের বরাত দিয়ে এতে বলা হয়েছে, দাঙ্গায় হস্তক্ষেপ না করার জন্য কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে নির্দেশও দিয়েছিলেন মোদি।
তবে নরেন্দ্র মোদি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং ভারতের শীর্ষ আদালতের তদন্তের পরে ২০১২ সালে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এছাড়া এই অভিযোগ থেকে মোদিকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে দায়েরকৃত আরেকটি পিটিশন গত বছর খারিজ হয়ে যায়।
এদিকে বিবিসির এই ডকুমেন্টারিকে ‘প্রোপাগান্ডার অংশ’ বলে অভিহিত করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেছেন, এই ডকুমেন্টারিটিতে ‘পক্ষপাত’, ‘বস্তুনিষ্ঠতার অভাব’ এবং ‘অবিচ্ছিন্ন ঔপনিবেশিক মানসিকতা’ ‘স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান’।
এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘এই ধরনের কাজের উদ্দেশ্য ও এর পেছনের এজেন্ডা সম্পর্কে আমরা বিস্মিত এবং এই ধরনের প্রচেষ্টাকে আমরা ভালো বলতে চাই না।’
অন্যদিকে বিবিসি জানিয়েছে, ডকুমেন্টারিটি ‘কঠোরভাবে গবেষণা’ করা হয়েছে এবং এতে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) লোকজনের বক্তব্যসহ বিস্তৃত পরিসরে ঘটনার বর্ণনা ও মতামত রয়েছে।
বিবিসির একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘ভারত সরকারের কাছে এই (গুজরাট দাঙ্গার) বিষয়ে সামনে আসা প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা (মোদি সরকার) প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করে।’
আল জাজিরা বলছে, বিবিসির ডকুমেন্টারিতে যুক্তরাজ্যের সাবেক একজন শীর্ষ কূটনীতিককেও দেখানো হয়েছে। তিনি বলেছেন, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) এই সহিংসতার পরিকল্পনা করেছিল।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদী আধাসামরিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) একটি শাখা। মোদি তার নিজ রাজ্য গুজরাটে অল্প বয়সে আরএসএসে যোগ দিয়েছিলেন।
তদন্ত দল বলেছে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) গুজরাট রাজ্য সরকারের তৈরি দায়মুক্তির পরিবেশ ছাড়া এতটা ক্ষতি করতে পারত না।
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময় যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন জ্যাক স্ট্র। বিবিসির ডকুমেন্টারিতে তার সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, গুজরাট দাঙ্গায় মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ তার (মোদির) খ্যাতি ক্ষুণ্ন করেছে।
জ্যাক স্ট্র বলেন, ‘বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ ছিল যে, মুখ্যমন্ত্রী মোদি পুলিশকে ফিরিয়ে আনতে এবং হিন্দু উগ্রপন্থীদের উৎসাহিত করতে বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। এটি বিশেষভাবে গুরুতর অভিযোগ ছিল।’
সাবেক এই ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা যা করেছি তা হলো তদন্ত দল গঠন করা এবং একটি দল গুজরাটে গিয়ে ঠিক কী ঘটেছে তা খুঁজে বের করেছে। এবং তারা খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।’
প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়েছে, ২০০২ সালের সহিংসতার সময় মুসলিম নারীদের ব্যাপকভাবে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছে, দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিল ‘হিন্দু এলাকা থেকে মুসলমানদের বের করে দেওয়া’। আর এটিই বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার অধীনে রাষ্ট্রীয় নীতি হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করে আসছেন সমালোচকরা।
আল জাজিরা বলছে, ২০১৪ সাল থেকে মোদির অধীনে বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে এবং এই সময়ে ভারতের মুসলমানরা বারবার সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পাশাপাশি নির্লজ্জ বৈষম্যের শিকার হয়েছে। যার সবগুলো ঘটনাই প্রায়শই রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এমনকি হিন্দু আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী এবং বিজেপির সমর্থকরাও ভারতকে একটি একচেটিয়া হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার দাবি জোরদার করেছে বলেও আল জাজিরার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।