নির্দিষ্ট কি-বোর্ড ব্যবহারের অযৌক্তিক বাধ্যবাধকতা ও গ্যাংস্টারিজম

সম্পাদকীয়

সব অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন সেটে বিজয় কি–বোর্ড ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা মানতে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সম্প্রতি যে চিঠি দিয়েছে, সেটাকে ‘শীতের দিনের উষ্ণ কৌতুক’ বলে উড়িয়ে দিতে পারলে নাগরিক সমাজকে একটা বাক্যও হয়তো খরচ করতে হতো না। প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিটিআরসির বিদ্যমান আইনের সঙ্গে চিঠির বক্তব্য সাংঘর্ষিক না হলে বিষয়টি তুমুল সমালোচনার জন্ম দিতো না। অন্য সফটওয়্যার বাদ দিয়ে শুধু ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের কি-বোর্ড ব্যবহারের বাধ্যবাধকতার প্রশ্নে স্বার্থের সংঘাতের (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) যেসব প্রশ্ন উঠছে, সেগুলোকে হুট করে অবান্তর বলার সুযোগ নেই।

প্রচলিত আইন ও নীতিমালায় বিটিআরসি স্বাধীন সংস্থা। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাটি। এমন চিঠি দিতে বিটিআরসিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বাধ্য করেছে কি না, এ প্রশ্ন উঠতে তাই বাধ্য। টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১-এর চতুর্থ অধ্যায়ে ২৯-এর গ ও ছ ধারায় স্পষ্ট করে দেশে উদ্ভাবিত বাংলা লেখার সফটওয়্যার ও কি-বোর্ডগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে প্রযুক্তিতে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। দেশে জনপ্রিয় কয়েকটি কি-বোর্ডকে বাদ দিয়ে মন্ত্রীর মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠানের কি-বোর্ডের একচেটিয়া বাজার দখলের উদ্যোগ বিটিআরসি তাই কিছুতেই নিতে পারে না। এতে টেলিযোগাযোগ আইন যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

শুধু বিটিআরসি নয়, কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবার নাম উল্লেখ করে কোনো সরকারি সংস্থা বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহারের নির্দেশ দিতে পারে না। কি–বোর্ড বা অ্যাপ ‘স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের’ (বিএসটিআই) বাধ্যতামূলক তালিকার কোনো পণ্য নয়। এটির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে বিটিআরসির মতো স্বাধীন সংস্থার কোনো সুযোগ নেই। ক্ষমতা ও প্রভাব ধরে রাখা, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আর স্বার্থের দ্বন্দ্ব সামনে এনে আইনগত বাধ্যবাধকতাকে ‘অর্থহীন’ মনে করার সুযোগও বিটিআরসির বেলায় নেই।

মত ও পথসহ সহযোগী বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, আনন্দ কম্পিউটার্সের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, বিজয় বাংলা কি–বোর্ড ও সফটওয়্যার আবিষ্কারের জন্য টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন। আনন্দ প্রিন্টার্স ও আনন্দ মুদ্রায়ণের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা থেকে শুধু বিজয় বাংলা কি-বোর্ড ব্যবহারের বাধ্যবাধকতার নির্দেশে স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্ন সামনে আসে। নৈতিকতার প্রশ্নে বিষয়টি খুুব গুরুত্ববপূর্ণ। যদিও নিজের প্রতিষ্ঠানের কি-বোর্ড ব্যবহারে বিটিআরসির বাধ্যবাধকতার নির্দেশে ‘স্বার্থের সংঘাত’ নেই বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন মন্ত্রী। তবে নির্দেশনার বিষয়টিকে বিটিআরসি কোনোভাবেই যৌক্তিক আইনি ব্যাখায় দাঁড় করাতে পারছে না বলে আমরা মনে করছি।

নাগরিকরা মুঠোফোন সেটে কোন কি-বোর্ড ব্যবহার করবেন, এটা বিটিআরসি নির্ধারণ করার এখতিয়ার রাখে না। এটা নাগরিকদের নিজস্ব স্বাধীনতার বিষয়। আলোচনায় কি-বোর্ড আছে বলে এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করা যায়। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশে ‘কি-বোর্ড গ্যাংস্টার’ বাড়ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা সারাবিশ্বেই এ বিষয়ে ভাবছেন, লেখালেখি করছেন। একইসঙ্গে গ্যাংস্টারিজম কমাতে কাজও করছেন।

অনলাইনভিত্তিক মাস্তানি, নিপীড়নকে মোটাদাগে ‘কি-বোর্ড গ্যাংস্টারিজম’ বলা হয়ে থাকে। এসব গ্যাংস্টারের উদ্দেশ্য অন্যদেরকে মানসিক পীড়ন দেওয়া। গুজব, অশ্লীলতা কি-বোর্ড গ্যাংস্টারদের হাতিয়ার। ইন্টারনেটনির্ভর মনোপীড়নমূলক মাস্তানি, নারী নির্যাতন বা সাইবার বুলিং আমাদের দেশেও বাড়ছে। এর শিকার হয়ে আত্মহত্যা করার ঘটনাও কম নয়। বিতর্কিত কোনো উদ্যোগ না নিয়ে বিটিআরসি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয় করে কি-বোর্ড গ্যাংস্টারিজম দূর করতে ভূমিকা রাখতে পারে।

শেয়ার করুন