পাঠ্যবই নিয়ে সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার বন্ধ হোক

সম্পাদকীয়

মোকতাদির চৌধুরী

আওয়ামী লীগের সরকার ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি উৎসব আয়োজন করে সারাদেশের প্রথম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরকে বিনামূল্যে বই দেয়। দেশ-বিদেশে বহুল প্রশংসিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের এ কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় এবারও খ্রিষ্টীয় বছরের প্রথমদিন বই উৎসবের আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে নতুন বই যখন গন্ধ ছড়ায়, ঠিক সেই সময় পাঠ্যবইকে ইস্যু করে প্রতিবছর মাঠে নামে হেফাজত, জামায়াতের মতো চিহ্নিত কয়েকটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক গোষ্ঠী।

পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে। চলতি শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর পর থেকে উগ্রগোষ্ঠীগুলো ধর্মবিশ্বাসের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে যেসব ভুুল ব্যাখা ছড়াচ্ছে, ‘দেখেও তা না দেখার ভান করার’ সুযোগ সংশ্লিষ্ট কারো নেই। ধর্ম ও বিজ্ঞানের অপব্যাখ্যা দেওয়া মৌলবাদী মহল গুজব ছড়াতে প্রমাণিত পারদর্শী। মুখপত্র ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপপ্রচারে তারা মেতে উঠেছে। এতে অনেক অভিভাবক, শিক্ষার্থী বিভ্রান্তির শিকার হতে পারেন।

universel cardiac hospital

কোনো শিক্ষার্থী আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তিসহ যুগোপযোগী শিক্ষা গ্রহণে ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হতে পারে- এমন পাঠ্যবই প্রণয়ন করছে সরকার। মৌলবাদীরা এর বিরোধী। স্টিমইঞ্জিনে প্রথম শিল্পবিপ্লব, বিদ্যুতে দ্বিতীয়, তৃতীয় কম্পিউটার-ইন্টারনেটে আর চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এসেছে মানুষের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স)। উদার প্রগতিশীল ও আধুনিক শিক্ষা, যা কর্মমুখী মানবসম্পদ সৃষ্টির উপযোগী, এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন উপযোগী পাঠ্যবই। তেমন পাঠ্যবইয়ের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনুধাবনে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বরাবরই অক্ষম বলে তারা অপরাজনীতি করছে।

পাঠ্যবইয়ে থাকা ডারউইনের বিশ্ব স্বীকৃত বিবর্তনবাদের আলোচনাকে উগ্রগোষ্ঠীগুলো বলছে ধর্মবিরোধী। বাঙালির সংস্কৃতি, হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর বিরোধিতা করছে তারা। তিন বছর আগের ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি বইয়ের ছবি দিয়ে এসব অপপ্রচার তারা চালাচ্ছে, ওই বই এখন সেখানেও চলে না বলে শিক্ষামন্ত্রী জানান। মত ও পথের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে পাঠ্য সনাতন ধর্ম সম্পর্কে লেখা ফেসবুকে ছড়িয়ে বলা হচ্ছে, আমাদের দেশে ইসলাম ধর্মবিরোধী লেখা পাঠ্য। জামায়াত, হেফাজতের বিভিন্ন পর্যায়ের পদধারী নেতাকর্মী এসব আধেয় (কনটেন্ট) ফেসবুকে শেয়ার করেছেন।

ফেসবুকের অপপ্রচার ভালোমতো যাচাই-বাছাই না করে ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দুটি দৈনিক পত্রিকা পাঠ্যবই নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় সংস্কৃতির নানা উপকরণ নিয়ে তৈরি করা হয়েছে নতুন পাঠ্যসূচির আলোকে রচিত পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ। বইগুলোতে স্থান পেয়েছে নানা ধরনের পুরাকীর্তির নামে দেব-দেবী, বিভিন্ন প্রতিমার ছবি। জলছাপে ছাপানো এসব প্রতিমার সঙ্গে মুসলমান শিক্ষার্থীর সংস্কৃতির কোনো মিল নেই। কৌশলে এসবই শেখানো হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে।

গান শোনা, নাচ, বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ইত্যাদি যন্ত্র ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পাশ্চাত্য ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেয়েদের ফুটবল খেলা, টিভি দেখা, অনলাইনে কার্টুন দেখার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি, অ্যান্ড্রয়েড মুঠোফোন সেটের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি, খেলাধুলার প্রতি প্রবণতা সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভ্রমণের জন্য দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরে যেতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।

দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদনে ভুল, খণ্ডিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশে কোনো সংবাদমাধ্যমকে যতোটা দায়িত্বশীল হতে হয়, তা পত্রিকাগুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের বেলায় পারেনি। দুঃখজনক হচ্ছে, শিক্ষা ও তথ্য বা সংশ্লিষ্ট কোনো মন্ত্রণালয় পত্রিকা দুটির ভুল ব্যাখ্যার জবাব তুলে ধরেনি।

যারা পাঠ্যবই নিয়ে ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে প্রশাসনের তৎপরতা তেমন লক্ষ্যণীয় নয়। আমরা আশা করবো, প্রশাসন এ বিষয়ে আরো উদ্যোগী ও কঠোর হবে। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদেরকে খুঁজে বের করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।

শেয়ার করুন