রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আপিল চূড়ান্ত শুনানির জন্য প্রস্তুত করতে দুই মাস সময় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগে জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন তুহিন। রিটকারীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর।
মঙ্গলবার (৩১ জানুয়ারি) প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এরপর সংগঠনের পক্ষ থেকে আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়। দীর্ঘ সময় পার হলেও সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা আপিলের ওপর এখনও শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি। তারই ধারাবাহিকতায় আজ সেটি শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে উঠে।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর ও বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন।
একই সঙ্গে আদালত ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সনদ দেন। দলটির পক্ষ থেকে হাইকোর্টের ওই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে আপিলও করা হয়। আপিলের নম্বর- ৭৭৮/১৩।
ওই রায় ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মুহসীন রশিদ বলেন, আদালত রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেছেন। ফলে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে। দলটির প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে আর কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টে নিবন্ধন বাতিল করে রায় দেওয়ার পর জামায়াতের পক্ষ থেকে আপিল আবেদন করা হয়েছে। তবে এখনও আপিল শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি।
বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকলে কোনো রাজনৈতিক দল দলীয় পরিচয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। হাইকোর্টের রায় বহাল অবস্থায় এখন থেকে আগামীতে যে কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
আইনজীবী মুহসীন রশিদ বলেন, নিবন্ধন বাতিল হওয়ার কারণে জামায়াতের নেতারা দলীয় পরিচয়ে আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তবে স্বাধীনভাবে অর্থাৎ ব্যক্তি পরিচয়ে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো প্রতীকে তাদের নির্বাচন করতে হবে। কোনোভাবেই জামায়াতের পরিচয় তারা ব্যবহার করতে পারবেন না।
২০০৯ সালে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ জন ব্যক্তি। রিট আবেদনে অভিযোগ করা হয়, জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ ও ভাবধারা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে ওই বছরের ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে রাজনৈতিক দল হিসেবে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ বি (১) (বি) (২) এবং ৯০ সি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও সংবিধান-পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না কেন, তা জানতে চাওয়া হয়। জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দলের আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ তিন মানবতাবিরোধী এবং নির্বাচন কমিশনসহ বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলোতে কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধীকরণের যোগ্য না হওয়ার বিষয়ে বলা আছে। ওই রুলের ওপর ১২ জুন পর্যন্ত নয়দিন শুনানি হয়।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মুহসীন রশিদ, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম। জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন আবদুর রাজ্জাক। তাকে সহায়তা করেন আইনজীবী বেলায়েত হোসেন।
শুনানিতে তানিয়া আমীর বলেন, যে গঠনতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছিল, তা ছিল নিবন্ধনের অযোগ্য। তাই নিবন্ধনের পর ওই গঠনতন্ত্র সংশোধনের সুযোগ নেই। জামায়াতের নিবন্ধন সংবিধানের ৭ ও ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। সংবিধানে রাজনৈতিক দল করার মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে; তবে কোনো দলের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে, দলের নীতিতে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গবৈষম্য থাকলে সংগঠন বা রাজনৈতিক দল করা যাবে না।
মুহসীন রশিদ বলেন, ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেয়া হয়। তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তাদের সাময়িক নিবন্ধন দেয়া হয়। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে তখন ইসি সিদ্ধান্ত নেয়। ইসির ওই সময়ের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী হয়েছে জামায়াতকে সাময়িক নিবন্ধন দেয়ার অনেক পরে।
২০০৮ সালে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধিত হয়। আইনানুযায়ী কোনো দল নিবন্ধিত না হলেও সংগঠন হিসেবে সক্রিয় থাকতে পারে কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না।