পটিয়ার ৪ গ্রাম ‘সংকটাপন্ন’ ঘোষণা করে সুপেয় পানি সরবরাহের নির্দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

পূর্ব ঘোষিত রায়ের আলোকে চট্টগ্রামের পটিয়ার ৪টি গ্রামকে পানি সংকাটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ওইসব গ্রামের আশপাশে থাকা আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছে গ্রামবাসী। এ অবস্থায় পটিয়ার হাবিলাস দ্বীপ ইউনিয়নের চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া এবং হাবিলাসদ্বীপ গ্রামে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ৩৫০টি টিউবওয়েল স্থাপন করে। এসব টিউবওয়েল বিকল হয়ে পড়লে গ্রামগুলোর প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়ে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর দেওয়া রায় বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

universel cardiac hospital

ওই রায়ের আলোকে পটিয়ার ৪টি গ্রামকে পানি সংকাটাপন্ন এলাকা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। রায়ে প্রদত্ত নির্দেশনাবলী অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে বিবাদীদের (সরকারি সংস্থাসমূহ) প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ওইসব গ্রামে সুপেয় পানির ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক (ডিজি), জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি), পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং সহকারী প্রকৌশলীকে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে রায়ে প্রদত্ত নির্দেশনাবলী বাস্তবায়ন করে আগামী ৩ মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

৩১ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) হাইকোর্টের বিচারপতি মাহমুদুল হক এবং বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

আদালতে আজ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট এস. হাসানুল বান্না। আদেশের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন অ্যাডভোকেট এস. হাসানুল বান্না।

আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার হাবিলাস দ্বীপ ইউনিয়নের চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া এবং হাবিলাস দ্বীপ গ্রামে পানির সংকট দেখা দেয়। এমনকি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর স্থাপিত ৩৫০টি টিউবওয়েল বিকল হয়ে পড়লে গ্রামগুলোর প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়ে।

আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভূ-গর্ভস্থ পানি তোলার কারণে গ্রামগুলোতে এ সংকট দেখা দেয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছয়টির পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই এবং বেশির ভাগই বর্জ্য শোধনাগার প্ল্যান ছাড়া পরিচালিত হচ্ছিল।

ওইসব প্রতিষ্ঠানের সৃষ্ট দূষণে পাশের বোয়লখালী, গরুলতা এবং আলমডাঙা খালের পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। ফলে সুপেয় পানির পাশাপাশি চাষাবাদের পানিরও তীব্র সংকটে পড়ে গ্রামবাসী। পরিবেশ অধিদপ্তর তিনটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করলেও প্রতিষ্ঠানগুলো আইন অমান্য করে এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে জরিমানা না দিয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।

তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- বনফুল অ্যান্ড কোম্পানি (ফুড প্রোডাক্টস), বনফুল অ্যান্ড কোম্পানি (মিনারেল ওয়াটার), আম্বিয়া নিটিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড, আম্বিয়া পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস লিমিটেড, মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেড, হাক্কানী পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস লিমিটেড, আনোয়ারা পেপার মিলস লিমিটেড ও শাহ আমানত নিটিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড।

এই মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে রিটটি চলমান ঘোষণা করেন। মামলার শুনানিতে পরিবেশ অধিদপ্তর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর দূষণ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন করে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড যেসব প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে তাতে স্পষ্ট হয় যে গ্রামগুলোতে এখন আর হস্ত চালিত পাম্প বা টিউবওয়েলের মাধ্যমে পানি উত্তোলন সম্ভব নয়। ফলে সরকার মাটির ১৫০ মিটার নিচ থেকে পানি উত্তোলনে সক্ষম এমন পাম্প বসিয়ে এলাকাবাসীর পানি চাহিদা মেটাতে উদ্যোগ নিচ্ছে।

সরকারের এমন উদ্যোগ ক্ষয়িষ্ণু ভূগর্ভস্থ পানি স্তরে আরও চাপ সৃষ্টি করবে জানিয়ে সরকারের এমন উদ্যোগের বিরোধিতা করে আদালতে বক্তব্য রাখেন বেলার আইনজীবীরা।

শুনানি শেষে আদালত পানি আইন ২০১৩-এ ধারা (১৭)- এর অধীনে চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া এবং হাবিলাস দ্বীপ গ্রামকে পানি সংকাটাপন্ন এলাকা ঘোষণার বিষয়ে আগামী ৩ মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে আদালত ওই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসককে আটিটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষণের পরিমাণ যাচাই করে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

ভবিষ্যতে এই ৪টি গ্রামে বিকল্প পানির ব্যবস্থা না করে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে কোন ‘লাল’ বা ‘কমলা-খ’ শ্রেণির শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হতে পারবে না। পটিয়া উপজেলায় পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া এবং কার্যকরী বর্জ্য শোধনাগার প্ল্যান ছাড়া কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান যেন পরিচালিত হতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আদালতের নির্দেশ প্রতিপালন বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে মেমো প্রস্তুত করে আদালতে দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পানি আইনের অধীনে দেশের কোনো এলাকাকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা দাবি জানিয়ে এটিই প্রথম আইনি পদক্ষেপ।

শেয়ার করুন