‘আমরা নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ চাই না।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে বলেছিলেন গত নভেম্বরে যখন তাঁরা বালিতে মিলিত হন। এভাবে চীন-আমেরিকার সম্পর্কের মধ্যে নতুন করে আশার আলো সঞ্চার হয়। গত জানুয়ারি মাসে জুরিখে দুই দেশের ঊর্ধ্বতন অর্থনৈতিক কর্মকর্তারা যোগাযোগ সম্প্রসারণ ও সহযোগিতার কথাও বলেছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের দুইদিনের বেইজিং সফর শুরু হওয়ার কথা ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি। এর আগেই আমেরিকার আকাশসীমায় ভেসে ওঠে চীনা ‘নজরদারি’ বেলুন।
এটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। বেলুনটি স্ট্রাটোস্ফিয়ার অঞ্চলেই ছিল, প্রায় ১৮ হাজার মিটার উপরে এবং সৌর প্যানেল দিয়ে সজ্জিত। এটি সাধারণত আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ব্যবহৃত বেলুনের চেয়ে অনেক বড়। তবুও চীন দাবি করে, মূলত আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য বেলুনটি আকাশে ওড়ানো হয়েছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট পথে না গিয়ে সেটি যুক্তরাষ্ট্র চলে গেছে।
মার্কিন প্রতিরেক্ষা দপ্তর ও বাকী বিশ্ব সেই যুক্তি আমলে নিতে নারাজ। আমেরিকা এটিকে একটি নজরদারি বেলুন বলে অভিহিত করে। ৪ ফেব্রুয়ারি বেলুনটিকে আটলান্টিক মহাসাগরে ভূ-পাতিত করে যুক্তরাষ্ট্র। আপাতত ব্লিঙ্কেনের বেইজিং সফরও স্থগিত করার কথা জানিয়েছে হোয়াইট হাউজ।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বেলুনটি আমেরিকার আকাশসীমায় প্রবেশ উচিত হয়নি। অন্য একটি বেলুন লাতিন আমেরিকায় খুঁজে পেয়েছে পেন্টাগন। ব্লিঙ্কেন তার সফর স্থগিত করে ঠিক করেছেন। বাইডেন প্রশাসনের চীনের উসকানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্তও সঠিক।
বেলুনটি গুলি করে ভূ-পাতিত করার অধিকার ছিল কেননা পেন্টাগনের মতে এটি তাদের আকাশসীমায় ছিল। তবে ঘটনাটিকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই দেশের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বড় পরিসরে দেখা দরকার।
চীন যে আমেরিকার ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করে তা গোপন নয়। তবে বেলুনটির গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতা সীমিত ছিল। এটি পেন্টাগনও স্বীকার করেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যখন আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র হয়, তখন ছোট ঘটনাগুলো সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। এটি প্রতিরোধ করার জন্য, চীন ও আমেরিকার তাদের সম্পর্ককে উন্নতি করার উপায় জরুরি হয়ে পড়ে। দু’দেশের সংযমের প্রয়োজনীয়তা আরও জরুরি কেননা উভয় দেশের উপদলগুলোর ‘দেশপ্রেমিক’ প্রমাণপত্র প্রদর্শনের সুযোগ তৈরি করবে।
এ ঘটনায় ওয়াশিংটনে ক্ষোভ জন্ম নিতে পারে। হাউজের নতুন দ্বিদলীয় চীন নির্বাচন কমিটির রিপাবলিকান প্রধান মাইক গ্যালাঘের বলেছেন, ‘এটি আমেরিকান সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি, এবং এটি মধ্য-পশ্চিমের জন্যও হুমকিস্বরূপ।’ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এটি ভূ-পাতিত করার কথা বলেছিলেন।
ডেমোক্র্যাটরাও এখন ক্ষুব্ধ। মন্টানার সিনেটর জন টেস্টার বেলুনটিকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ‘স্পষ্ট হুমকি’ বলে অভিহিত করেছেন। চীন নির্বাচন কমিটির র্যাঙ্কিং ডেমোক্র্যাট রাজা কৃষ্ণমূর্তি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বাইডেন প্রশাসনের কাছে জবাব চাইছি।’ যদিও চীনের প্রতি এমন শত্রুতার জায়গা বাইডেনের কৌশলে নেই।
চীনের রাজনৈতিক পরিবেশও কম উত্তেজনাপূর্ণ নয়। চীন সরকার আমেরিকার আকাশসীমায় বেলুনের ‘অনিচ্ছাকৃত’ প্রবেশের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছে। বলা চলে, চীন স্বীকার করবে যে এটি তারা ভুল করেছে। সর্বোপরি শি, পশ্চিমের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর লক্ষ্য নিয়েছিলেন। ঠিক যেমন তিনি তার সাম্প্রতিক নীতির মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেন, চীন বিনিয়োগের জন্য একটি ভালো জায়গা।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুঃখপ্রকাশ করলেও, দেশের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই, ব্লিঙ্কেনকে বলেছিলেন, চীন ‘কোনো ভিত্তিহীন অনুমান বা মিথ্যাচার গ্রহণ করবে না।’
ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ‘বেলুনকাণ্ড’ বাড়বে না। চীন ও আমেরিকার মধ্যে উত্তেজনা কতটা তীব্র হতে পারে তা দু’দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। বাইডেন ও শি যদি দুর্ঘটনা, ত্রুটি এবং ভুল বোঝাবুঝির দ্বারা সম্পর্ক নির্ধারণ করতে না চান তবে তাদের যোগাযোগের আরও ভালো উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
বেলুনটি আমেরিকার আকাশসীমায় প্রবেশের অনেক আগে, ঝুঁকি কমানোর জন্য নতুন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছিল দেশ দুটির। বাইডেন প্রশাসন স্পষ্টভাবে জানায়, দুই পক্ষের সামরিক নেতাদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের লাইন খোলা এবং তাদের জাহাজ ও বিমানগুলো নিরাপদে যোগাযোগ করার জন্য প্রোটোকল প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তবে চীন আরও সতর্ক হয়েছে, কেননা যেকোনো চুক্তিকে তার সামরিক বিকল্প সীমিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে দেশটি।
চীন-আমেরিকার সম্পর্কের উত্তেজনা ততটা নয় যতটা সোভিয়েত-আমেরিকার সম্পর্কে ছিল। কিন্তু ওয়াশিংটন ও মস্কোর কর্মকর্তারা ঝুঁকি এড়াতে কার্যকর উপায় বের করার আগে এটি একটি ক্ষেপণাস্ত্র সংকট তৈরি করেছিল। তবে পারমাণবিকের পরিবর্তে ‘বেলুনকাণ্ড’ ভালো, যা আমেরিকা ও চীনকে একে অপরের সঙ্গে কীভাবে কথা বলা যায় তা স্পষ্ট করেছে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট