গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (জিএইচআই) উদ্বেগজনক অবস্থান থেকে মাঝারি অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। যেখানে ১২১টি দেশের মধ্যে ৮৪তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে বর্তমান খাদ্য ব্যবস্থা, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করতে তা যথেষ্ট নয়। এ কারণে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিয়ে এক ধরনের চাপা উদ্বেগ রয়েই গেছে।
বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর খামার বাড়ি এলাকায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-২০২২ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। ২০২২ সালে ১২১টি দেশকে এ গবেষণার আওতায় আনা হয়েছে। ওয়েল্ট হাঙ্গার লাইফ, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও হেলভেটাস বাংলাদেশের যৌথভাবে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
ওয়েলট হাঙ্গার লাইফ বাংলাদেশের হেড অব মিশন ফাতিমা আজিজোভা সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা মহামারি এবং জলবায়ু পরিবর্তন লাখ লাখ মানুষের আর্থসামাজিক অবনতির অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের (জিএইচআই) স্কোর অতীতের তুলনায় ভালো হয়েছে। উদ্বেগজনক মাত্রা থেকে মাঝারি মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট যে বর্তমান খাদ্য ব্যবস্থা, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করার জন্য তা যথেষ্ট নয়।
সব স্তরে অধিকারভিত্তিক খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে জানিয়ে ফাতিমা আজিজোভা বলেন, এটি অর্জনের জন্য সরকার, এনজিও এবং অন্য স্টেকহোল্ডারদের অবশ্যই স্থানীয় জনগণকে কাজে লাগাতে হবে এবং তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে স্থানীয় নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে মাল্টিস্টেকহোল্ডার প্ল্যাটফর্মগুলোকে সংগঠিত করে খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তাহীনতা এবং ক্ষুধা মোকাবিলায় নীতি নির্ধারকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-২০২২ এর সূচকে দেখা যায়, বাংলাদেশ ১২১টি দেশের মধ্যে ৮৪তম স্থানে রয়েছে। এছাড়া গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের অগ্রগতি একই রকম হচ্ছে এবং বর্তমানে ক্ষুধা সূচকে ১৯ দশমিক ৬ স্কোর নিয়ে মাঝারি অবস্থানে আছে। তবে দেশে বিগত বছরগুলোর তুলনায় দৃশ্যমান উন্নতি দেখিয়েছে বলে জানানো হয়।
এছাড়াল গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-২০২২ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৪ থেকে শতকরা ২৫ দশমিক ৫ ভাগ উন্নতি করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৬ দশমিক ৩, যা ক্ষুধা সূচকে গুরুতর বলে বিবেচিত হয়। ২০১৪ সাল থেকে এদেশে অপুষ্টির হার, শিশু স্টান্টিং এবং শিশুমৃত্যুর হার সবই কমে গেছে। শিশু অপচয়ের হার পূর্ববর্তী বছরগুলোতে উচ্চ হার ছিল। এ হারও ২০১৪ সালের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশের তুলনায় বর্তমানে ৯ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
অনুষ্ঠানে আলোচকরা জানান, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে চাইল্ড স্টান্টিংয়ের হার বাংলাদেশে কমে আসা একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। যদিও বর্তমানে শিশু স্ট্যান্টিংয়ের মাত্রা ২৮ শতাংশ, যা উচ্চহার হিসেবে বিবেচিত করা হচ্ছে।
আলোচকরা জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ উন্নতি করলেও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, চরম আবহাওয়া, ভয়াবহ বন্যা এবং জলবায়ু সংকটের কারণে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা ক্রমশ হুমকির মুখে পড়ছে। দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের মতো বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের শিকার সমাজের দরিদ্রতম অংশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অনুষ্ঠানে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ (কেআইবি)-এ কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-২০২২ উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের (বিএনএনসি) মহাপরিচালক ড. হাসান শাহরিয়ার কবির এবং কৃষি গবেষণা পরিষদ বাংলাদেশের নির্বাহী সভাপতি ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার।
কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর মনীশ কুমার আগরওয়াল বলেন, বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা এবং জিএইচআই অনুযায়ী পুষ্টিসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি করেছে। কিন্তু কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে মৌলিক খাবারের সংস্থানও এরই মধ্যেই দেশ ও বিশ্বের অনেক দরিদ্র পরিবারের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
তিনি বলেন, বিশাল চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। যা গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স রিপোর্টে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু তারপরও খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিয়ে একটা চাপা উদ্বেগ রয়েছে।
হেলভেটাস বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর শামীম আহমেদ বলেছেন, খাদ্যের প্রাপ্যতা সবসময় মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা সীমিত করার প্রধান কারণ নয়। তাই, সব স্তরের সরকারি ও বেসরকারি দায়িত্বশীলদের অবশ্যই খাদ্য ব্যবস্থার পরিবর্তনের এ প্রচেষ্টার কেন্দ্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন ও জবাবদিহিতা রাখতে হবে এবং খাদ্যের অধিকারকে সম্মান, সুরক্ষা এবং পূরণ করার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্স জানায়, চারটি মূল সূচকের ওপর ভিত্তি করে দেশগুলোকে বাছাই করা হয়। এগুলো হলো অপুষ্টি, চাইল্ড স্টান্টিং, চাইল্ড ওয়েস্টিং এবং শিশুমৃত্যুর হার। ২০২২ সালের প্রতিবেদনে ১২১টি দেশকে এ গবেষণায় স্থান দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৪৪টি দেশে ক্ষুধার মাত্রা গুরুতর বা উদ্বেগজনক।