যানজটে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নগরবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক

নানা উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিয়ে রাজধানীর যানজট আজকাল কোন মাত্রায় পৌঁছেছে, তা বাসিন্দাদের রোজকার অভিজ্ঞতাই বলে দেয়। রাস্তায় বসে বসে কান্না পাচ্ছে, চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে- ঢাকার নানা শ্রেণি পেশার মানুষের এমনটা মনে হয় প্রতিদিন। কারণ, সাম্প্রতিক যানজটে প্রায়ই মনে হয়, ঢাকা শহর যেন নড়ছে না, ছবির মতো স্থবির হয়ে আছে। কার্যকর উদ্যােগের অভাবে দিনে দিনে যানজট পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে।

যানজটের কারণে সময় ও অর্থ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বাসিন্দারা যানজটে বসে বসেই নানা স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তাদের স্বাস্থ্য সমস্যার বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।যানজটে সময় ও আর্থিক ক্ষতি বেশি আলোচিত হলেও শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত ক্ষতিও কম নয়। দীর্ঘক্ষণ যানজটে পড়ে নাগরিকদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে, উদ্বেগ বাড়ছে। কমছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুস ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, কিডনি, হৃদযন্ত্র ও প্রজননতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

রাজধানীতে প্রতিদিন মারাত্মকভাবে শব্দ ও বায়ুদূষণ হচ্ছে। এতে যাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। নিয়মিত যানজটের বিরক্তি থেকে মানুষের সংসার ভাঙার ঝুঁকি বাড়ে ৫০ শতাংশ। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশ ও স্নায়ুবিক ক্ষতির অন্যতম কারণও অতিরিক্ত যানজট বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, যানজট রোধে এখনই দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আগামীতে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি চরমে পৌঁছবে।

রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে সদরঘাটগামী একাধিক গণপরিবহন চালক বলেন, আগে এ রুটে যানজটে আটকে পড়ার গড় হিসাব ছিল ১ থেকে দেড় ঘণ্টার মতো। এখন সেটি বেড়ে ২ থেকে ৪ ঘণ্টার মতো হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, যানজটে পড়ে সময় ও আর্থিক ক্ষতির চিন্তায় অনেক যাত্রী চালক-হেলপারের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হলেও তারা তা বুঝতে পারেন না। যানজটে সৃষ্ট মানসিক চাপে অনেকের হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি মুমূর্ষু রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত রাস্তায় আটকে থাকায় রোগী ও অভিভাবকদের বিপাকে পড়তে হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের শরীরে প্রতি মিটার কিউবে গড়ে ১০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত দূষণ সহনীয়। ঢাকার বাসিন্দাদেরকে গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ মাইক্রোগ্রাম বায়ুদূষণ সহ্য করতে হচ্ছে। যানজটে আটকা পড়লে সেটি প্রতি মিটার কিউবে ৬০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত হচ্ছে। এতে ফুসফুস ও প্রস্টেটগ্রন্থির ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা জিপজোটের গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বে মানসিক চাপের শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান সপ্তম। এর প্রধান কারণ হিসাবে যানজটকে দেখানো হয়েছে। কানাডার সেন্টার ফর ড্রাগ অ্যাডিকশন অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ (সিডিএএমএইচ) এক গবেষণায় বলেছে, যানজটের মানসিক চাপ নিয়মিত গ্রহণ করলে মানসিক অস্থিরতা তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়ে ৫০ শতাংশ। নিয়মিত যানজটের বিরক্তি থেকে মানুষের সংসার ভাঙার ঝুঁকি বাড়ে ৫০ শতাংশ।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ‘ফন্ট্রিয়ারস-২০২২: নয়েজ ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ প্রতিবেদনে বলছে, বর্তমানে ঢাকার শব্দের গড় তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল, যা বিশ্বের ৬১টি জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ঢাকার বেশিরভাগ সময় শব্দের মাত্রা থাকে সহনীয় মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। যা বাসিন্দাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করছে।

শেয়ার করুন