ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতিপদক’ পেলেন ৯ গুণী ব্যক্তি

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দেশের ৯ জন গুণী ব্যক্তিকে ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতিপদক দেওয়া হয়েছে।

২৪ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) সন্ধ্যায় জেলা শহরের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তাদের এ পদক প্রদান করা হয়।

universel cardiac hospital

ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগিতায় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গুণীজন সংবর্ধনা পরিষদ।

পদক পেয়েছেন চিকিৎসায় ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ, শিক্ষায় নর্থ সাউথ ইউনির্ভাটির উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম, সাংবাদিকতায় এখন টেলিভিশনের সম্পাদকীয় প্রধান তুষার আবদুল্লাহ, সাহিত্যে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, প্রশাসনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, আইনশৃঙ্খলায় পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের ডিআইজি (অপারেশন্স) মো. মনিরুজ্জামান, সঙ্গীতে কণ্ঠশিল্পী শুভ্র দেব, সংস্কৃতিতে (পুরুষ) চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ এবং সংস্কৃতিতে (নারী) অভিনেত্রী তারিন জাহান।

পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। গেস্ট অব অনার ছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস এর ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।

আঁতাত করে কখনও সুফল পাওয়া যাবে না: মোকতাদির চৌধুরী

পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, একসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার পীঠস্থান। কিন্তু এখন আমরা আর আগের অবস্থায় নেই। কারণ আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে চারিত্রিক দ্বৈততা যাচ্ছে না। সাম্প্রদায়িক শক্তির সামনে মাথা উচু করে দাঁড়ানোর কেউ নেই। বরং রাতের অন্ধকারে তাদের সঙ্গে আপোষ করার জন্য রাজনৈতিক নেতারা আছেন এবং আমরা যারা শিক্ষিত জনেরা আছি, তারাও আছি।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ভাঙা হয়েছে। রেল স্টেশন একটি নিরপরাধ প্রতিষ্ঠান, প্রায় শতবছরের পুরোনো, এটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রেলস্টেশন কেন পুড়ানো হয়েছে জানেন? রেলস্টেশন হলো সাইন্স এন্ড টেকনোলজির প্রতীক, সুতরাং যারা সাইন্স এন্ড টেকনোলজির বিরুদ্ধে তারাই বলতে পারে ভেঙে দাও রেলস্টেশন! একবার নয় দুবার পুড়িয়েছে। আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে পুড়িয়েছে দুবার। এই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্তর পুড়িয়েছে একবার। অপরাধ এটি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে! কারণ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছিলেন।

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, নৌকা বাইচ একটি নিরপরাধ ও নির্মল ক্রীড়া অনুষ্ঠান, পাকিস্তান আমলেও এখানে এটি চালু ছিলো, ঐসব প্রতিষ্ঠানে তাদের যারা ওস্তাদ ছিলেন তারা কখনোই এটিকে হারাম বলেননি। কিন্তু আফগানিস্তানের উত্থানের পরে এখানে আজগুবি ফতোয়া দিয়ে এটি হারাম ঘোষণা করা হয়! আমরা এটি পুনরায় চালু করেছি।

তিনি বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল যাত্রা ও পুতুল নাচের পীঠস্থান, কিন্তু আজকে এগুলো বিলুপ্তির পথে।ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যারা আছেন সবাইকে এর পক্ষে দাঁড়াতে হবে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বঙ্গবন্ধু এটিই চেয়েছিলেন।

বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক আরও বলেন, সংস্কৃতির বন্ধ দরজা এই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে সেদিনই খোলা হয়েছিল যেদিন সাজিদুর রহমান নামে এক মিথ্যাবাদী মৌলভী তৎকালীন এসপি জামিল আহমেদকে ফোন করে বলেছিলেন এসপি সাহেব আপনি এই প্রোগ্রামটি (কনসার্ট) বন্ধ করে দিন। তখন ওনি (এসপি জামিল আহমেদ) ঐ মৌলভীকে বলেছিলেন, আপনি আসুন আমি সেখানে গান করব এবং বাঁশি বাজাবো। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে এই অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, আঁতাত করে কখনও সুফল পাওয়া যাবে না। এরা আঁতাতের লোক নই। গতবার ভাঙচুরের ভাঙচুরের পরে আমি তাদেরকে আহ্বান জানিয়েছিলাম তাদেরকে কোনো যাকাত দিবেন না, তাদেরকে কোনও সাহায্য-সহযোগিতা করবেন না। তার কিয়দংশ হলেও কাজে লেগেছে। অন্তহীনভাবে তারা মিথ্যার বেসাতী করে যায়। সত্যের ধারেকাছেও থাকতে চাই না, সত্য তারা জানেও না।

অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনারের বক্তব্যে অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দুটোই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী জিয়াউর রহমানের চালু করা, আমি তো ভেবেছিলাম যে, সরকার অন্তত ধীরেন্দ্রনাথ দত্তর সম্পর্কে একটি পদক চালু করবেন। সে কথাটি অবশ্য সরকার পর্যন্ত পৌঁছেও না, কারণ সরকারকে পরিচালনা করে যারা, বিশেষ করে আমলা, তাদের মাথায় এতো কল্যাণকামী চিন্তা ঢুকে না। এক্ষেত্রে সরকারের নিজস্ব ভাবনারও কোনো অবকাশ নেই।

তিনি বলেন, আমরা আমাদের ইতিহাসকে ধারণ করি না, আমরা কেউ ইতিহাস পড়ি না। ইতিহাসকে ধারণ করলে ইতিহাস পড়লে দেখা যাবে ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট কলকাতায় মিল্লাত পত্রিকার সম্পাদকের কক্ষে বসে ২৭ বছরের তরুণ যুবক শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করতে হবে। আমি বঙ্গবন্ধুকে বলি ভাষা আন্দোলনের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা।

তিনি আরও বলেন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত শুধু একাত্তরের শহীদ না, তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের শহীদ। ১৯৪৮ সালের ২ত ফেব্রুয়ারী তিনি পাকিস্তানের সংবিধান সভায় প্রথম বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্ত করতে দাবি তুললেন। বাংলা একাডেমি একুশের আলোচনায় কোনো দিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে আনেনি। আমি কাজ করবার সময়, ১৯৯৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি একুশের আলোচনায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে প্রথম নিয়ে এলাম।

গুণীজন সংবর্ধনা পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা আশীষ কুমার চক্রর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন, সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ প্রমুখ।

শেয়ার করুন