রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এই এক বছরে দুনিয়া অনেকটা বদলে গেছে। এমন কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, যা খুব কম মানুষই ধারণা করতে পেরেছিলেন। প্রতিবেশী দুই দেশের যুদ্ধে ইউক্রেনের যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনি ইউক্রেন থেকে বহু দূরের দেশের মানুষের জীবনে এর অভিঘাত লেগেছে, দেশে দেশে অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। খবর নিউইয়র্ক টাইমসের।
এই যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বের যে ভোগান্তি হয়েছে বা হচ্ছে, তাতে তিনটি ক্ষেত্রে প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। এগুলো হলো খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি আর মূল্যস্ফীতি। যুদ্ধের আঁচ প্রায় সব দেশে লেগেছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। এসব দেশে যুদ্ধের প্রভাব সবচেয়ে প্রকট হয়েছে।
খাদ্যদ্রব্যের কথাই যদি বলা হয়, তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। এর কারণ রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বে গমসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় দুই দেশ। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে কোটি কোটি মানুষ বিশেষ করে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অংশের মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে পড়েছে।
গত বছরের জুলাইয়ে মস্কো ও কিয়েভ খাদ্যশস্য রপ্তানি নিয়ে একটি চুক্তি করে। এই চুক্তির কল্যাণে ইউক্রেনে আটকে থাকা কোটি কোটি টন খাদ্যপণ্য রপ্তানির সুযোগ তৈরি হয়। এসব পণ্য আটকা পড়ার কারণ কৃষ্ণসাগরে থাকা ইউক্রেনের বন্দরগুলো থেকে খাদ্যপণ্য রপ্তানি করা যাচ্ছিল না। কারণ, রাশিয়া নৌপথ অবরোধ করে রেখেছিল।
তবে গত বছরের অক্টোবরে এসে হঠাৎ করে রাশিয়া এই চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে এরপরও চুক্তিটি এখনো বলবৎ আছে। ইউক্রেন থেকে খাদ্যপণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এতে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত শতকের সত্তরের দশকের পর সবচেয়ে ভয়াবহ জ্বালানিসংকটে পড়েছে বিশ্বে। নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক দেশ রাশিয়া থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ বা কমিয়ে দেয়। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জ্বালানির দাম এক লাফে অনেক বেড়ে যায়।
যুদ্ধের প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই ইউরোপে বাসিন্দাদের গ্যাসের বিল দ্বিগুণ এবং বিদ্যুতের খরচ ৭০ শতাংশ বেড়ে যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকেরা গত ডিসেম্বরে রাশিয়ার জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ মার্কিন ডলারে বেঁধে দেন।
ইউক্রেন যুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন বিশ্ব অর্থনীতি সবে করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে উঠছিল। যুদ্ধ শুরুর পর জ্বালানিসংকট ও প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি তরতর করে বাড়তে শুরু করে। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কমে যায় মুদ্রার মান। মানুষের তাদের সঞ্চয়ের অর্থ ভেঙে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা শুরু করে। এতে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়। এতে করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে শুরু করে।
মূল্যস্ফীতি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ দেশে দেশে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারগুলো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নগদ প্রণোদনা দিতে শুরু করে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ভর্তুকি, পণ্যের মূল্য বেঁধে দেওয়া, এমনকি কর কমানোর পদক্ষেপও নেয়।
যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের ৮০ লাখের বেশি নাগরিক ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। ইউক্রেনের ভেতরে বাস্তুচ্যুত অর্থাৎ গৃহহীন হয়েছেন আরও ৫০ লাখ ইউক্রেনীয়। একই সঙ্গে এই যুদ্ধ ইউরোপে পোল্যান্ড ও বাল্টিক দেশগুলোর ওপর প্রভাব বাড়িয়েছে। কারণ, এসব দেশ ইউক্রেনের পক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং ইউক্রেনকে বড় ধরনের সামরিক সাহায্য ও দ্রুত অস্ত্র সরবরাহের জন্য চাপও দেয়।
তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশের নেতারা শুরুর দিকে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কারণ, এসব দেশ দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপের ‘নিরাপত্তা কাঠামো’ মানার নীতি মেনে আসছিল। এই নীতি অনুযায়ী, রাশিয়ার সঙ্গে বৈরিতা নয়, সহযোগিতার সম্পর্ক রাখতে হবে।