সব ধর্মীয় উপধারার অনুসারীর নিরাপত্তা চাই

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। ফাইল ছবি

শুধু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা অন্য ধর্মের অনুসারীরাই নন, একই ধর্মের অন্যান্য উপধারার মানুষও মৌলবাদের কাছে নিরাপদ নন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা তৎপরতার মধ্যে উগ্রগোষ্ঠীগুলো বারবার এর জানান দিতে সক্ষম হচ্ছে। গত শুক্রবার পঞ্চগড়ে আহমদিয়া মুসলমানদের সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ, হামলা, অগ্নিসংযোগ করে তারা। তাদের তাণ্ডব চলাকালে দুই তরুণের মৃত্যু হয়। পঞ্চগড়ের আক্রমণের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ২০১৯ সালেও এমনভাবে আহমদিয়া সম্প্রদায় সেখানে আক্রান্ত হয়। দেশে শিয়া মুসলমানরাও কয়েক বছর আগে জঙ্গিবাদীদের আক্রমণের শিকার হন।

আধুনিক কোনো রাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে নিজের ধর্ম পালনের অধিকার সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক মানবাধিকার। যা যে কোনো ধর্মের ধারা-উপধারার অনুসারীদের বেলায়ও সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই কোনো ধর্মের অনুসারীদের উপর আক্রমণের ঘটনা ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার সাংবিধানিক নীতির পরিপন্থি। একই ধর্ম ইসলাম নিয়ে ব্যবসার মাঠে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে নানা ফেরকা। একটা গোষ্ঠী আরেকটা গোষ্ঠীকে ‘মুরতাদ’ বলেও ফতোয়া দিচ্ছে। তাদেরটা ‘আসল ইসলাম’, বাকিগুলো ভুয়া। এই হলো উগ্রগোষ্ঠীগুলোর মতবাদ।

আশ্চর্যজনক হচ্ছে- একটা বিষয়ে সবসময়ই মৌলবাদীগোষ্ঠীর মধ্যে ভয়ংকর ঐক্য। সেটা হলো- ধর্মীয় বিশ্বাসের নিরিখে সংখ্যালঘুকে নির্যাতন, হত্যা, নারী ধর্ষণ, তাদের সম্পত্তি লোপাট। তাদের উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, তাদেরকে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনে বর্বর রকমে বাধা দেওয়া। সাবেক পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের একান্ন বছরের ইতিহাসে যতো সাম্প্রদায়িক নৃশংসতা, দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে, প্রত্যেকটার প্রতি সব মৌলবাদী গোষ্ঠীর নানাভাবে সমর্থন, সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।

একাত্তরের নরঘাতকদের দল জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদী পাকি শাসনামলে ‘কাদিয়ানিরা কাফের’ ফতোয়া দিয়ে যে নৃশংস দাঙ্গা বাধিয়ে দেন, সেই তত্ত্ব ও জঘন্য মতাদর্শ ধারণ করে এবং সেগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই কার্যক্রম চালিয়ে আসছে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর হেফাজতসহ অন্যান্য উগ্র সংগঠন। হেফাজত, ইসলামি আন্দোলনের মতো সংগঠনগুলো শুরু থেকেই দাবি জানিয়ে আসছে পাকিস্তান যেভাবে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিকভাবে কথিত ‘অমুসলিম’ ঘোষণা করে, বাংলাদেশেও যেন সেটা করা হয়।

তাই কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক বর্বরতার জন্য অভিযুক্ত হিসেবে কথিত ‘তৌহিদী জনতা’, বা যাদের নামই সামনে আসুক, এর পেছনে সব মৌলবাদী সংগঠন কম-বেশি দায়ী থাকে। তাদের ইন্ধন থাকে। সারাবছর তাদের ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য-বিবৃতি ও কার্যক্রম বর্বরতায় উদ্ধুদ্ধ করে।

দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুক্ত করতে মৌলবাদীদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা আছে, সেগুলোর বাস্তবায়নে এক উগ্র সংগঠন অন্য সংগঠনকে সাম্প্রদায়িক হামলায় নেতাকর্মীসহ আর্থিক ও অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে থাকে। ফলে আমরা দেখি, ‘ঈমানী জনতা’, ‘তৌহিদী জনতা’- যে ব্যানারেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হোক, এতে অংশ নেওয়া লোকগুলো জামায়াত, হেফাজতের মতো সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, সেগুলোর পদধারী নেতাকর্মী। প্রশাসনের তদন্তে বারবারই সেটা বেরিয়ে আসে।

সংখ্যালঘুদের উপর হামলার বিষয়গুলোকে তাই সামগ্রিকভাবে দেখা জরুরি। কোনো ঘটনার জন্য মাঠে অভিযুক্তদের পাশাপাশি এ ধরনের উগ্রবাদে বিশ্বাসী সব সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবতে হবে। অমুক সংগঠন আপাতত আমাদের দিকে আছে কী নেই বিবেচনায় প্রগতিশীল সরকারের প্রশাসনের পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, সব মৌলবাদীর চরিত্র একইরকম, বিষধর সাপের মতো। সাপ খোলস পাল্টায় শুধু, বিষ বদলায় না।

পঞ্চগড়ে আহমদিয়া মুসলমানদের উপর হামলা, তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চালানোর পর তিনদিন কেটে গেলেও এখনো পর্যন্ত ঘটনার তদন্তে কোনো কমিটি গঠন হয়নি। ঘটনার পরপর মামলা পর্যন্ত দায়ের হয়নি। শুক্রবার তাণ্ডবের পর শনিবার রাতে মামলা দায়ের হয়। নির্যাতিত আহমদিয়া সম্প্রদায় প্রাণ বাঁচাতে মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রশাসন তাদের সঙ্গে সেভাবে নেই, বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে পারছে না, অবস্থাদৃষ্টে সেটাই মনে হচ্ছে। প্রশাসনের এমন ভূমিকাকে আমরা কিছুতেই সমর্থন করতে পারছি না।

অনেকে অভিযোগ করছেন, পঞ্চগড়ের প্রশাসন মৌলবাদীগোষ্ঠীর প্রতি ‘নমনীয়’! এমন অভিযোগ সত্য কী না, সেটা স্থানীয় প্রশাসনকেই প্রমাণ করতে হবে। ঘটনার তিনদিন পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্ত উগ্ররা গ্রেপ্তার, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও তদন্ত কমিটি গঠন না হওয়ার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কারো, বা কোনো পক্ষের গাফিলতি আছে কী না, সেগুলোরও তদন্তের দাবি জানাই। কারো গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে জবাবদিহির আওতায় আনা হোক। এ দেশ যেন তেমন ইসলামি জঙ্গিবাদের শিকারে পরিণত না হয়, সে জন্য সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো ও জনগণকে মিলিতভাবে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

লেখক: সংসদ সদস্য। সম্পাদক, মত ও পথ।

শেয়ার করুন