ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও তাত্ত্বিক আলাপের জেরে নৃশংস হামলা কাম্য নয়

সম্পাদকীয়

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি।
র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। ফাইল ছবি

পঞ্চগড়ে গত ৩ মার্চ, শুক্রবারে আহমদিয়া মুসলমানদের উপর নৃশংস হামলার পর ৫ মার্চে আমরা মত ও পথে বিশেষ কলাম প্রচার করি। ‘সব ধর্মীয় উপধারার অনুসারীর নিরাপত্তা চাই’ শিরোনামে। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চালানোর পর তখন তিনদিন কেটে গেলেও ঘটনার তদন্তে কোনো কমিটি গঠন না হওয়া, ঘটনার পরপর মামলা না হওয়া ও অভিযুক্ত উগ্রদেরকে গ্রেপ্তারে স্থানীয় প্রশাসনের জোরালো তৎপরতা না থাকার বিষয়গুলোর আমরা কঠোর সমালোচনা করি ওই লেখায়। এরপর স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতা বাড়তে দেখি। সেজন্য প্রশাসনকে আমরা সাধুবাদ জানাই।

আহমদিয়াদের সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে তাদেরকে নির্যাতন, হত্যা, তাদের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশ এখন পর্যন্ত মোট ১৭৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। গতকাল বিকেল থেকে আজ শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে নতুন করে তিনটি মামলা হয়। ফলে মোট মামলার সংখ্যা ১৬টি। এসব মামলায় আসামি বারো হাজারের বেশি। আজ ওই ঘটনার একসপ্তাহ পার হয়ে গেলেও তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানা যাচ্ছে না। যা অবশ্যই দুঃখজনক। ছোটখাটো অনেক ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন হওয়ার ভুরি ভুরি নজির আছে দেশে। পঞ্চগড়ের প্রাণঘাতী ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন না করার কী কারণ থাকতে পারে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

শুধু মামলা ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা দিয়ে একধরনের ‘আত্মসন্তুষ্টি’ পাওয়া গেলেও পঞ্চগড়ের সাম্প্রদায়িক বর্বরতার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে না। কারা, কেন এসব কাণ্ড ঘটিয়েছেন, সেগুলো আগে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এরপর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া ধর্মীয় উগ্রগোষ্ঠীগুলোর সাম্প্রদায়িক হামলা রুখতে স্থানীয় প্রশাসন আগেভাগে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তারা পরিস্থিতিও সামাল দিতে পারেনি। আমরা মনে করি, পুরো ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা জরুরি। স্থানীয় প্রশাসনের কারো, বা কোনো পক্ষের গাফিলতি আছে কী না, সেগুলোরও তদন্তের দাবি জানাই। কারো গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে জবাবদিহির আওতায় আনা হোক।

আজ শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে আহমদিয়া মুসলমানদের উপর আবার হামলার ঘটনা ঘটে কী না, এমন উদ্বেগ স্থানীয় অনেকের মধ্যে ছিলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক অভিযান ও নজরদারিতে জেলা শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিলো। আজ জেলা শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর ও শালশিড়ি এলাকার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের দুটি মসজিদে ও তাদের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো হয়। গত শুক্রবারের আগে প্রশাসন এমন উদ্যােগ নিলে ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা ঠেকানো যেত। এতে দুই তরুণকে হয়তো প্রাণ দিতে হতো না।

কারণ, ৩ ও ৪ মার্চ আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসা কর্মসূচি ঘোষণা এবং তা ঠেকাতে কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠনের তৎপরতা স্থানীয় প্রশাসনের আগেভাগে জানা ছিলো। তাছাড়া, হামলার ঘটনা এবারই প্রথম নয়, ২০১৯ সালেও জলসা ঘিরে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে পঞ্চগড়ে। অতীতের অভিজ্ঞতার কথাও মাথায় রাখেনি প্রশাসন। প্রতিবছরের এ সময় আহমদিয়ারা বার্ষিক ধর্মীয় সমাবেশের আয়োজন করে থাকেন। সাধারণত সালানা জলসাগুলো একেক বছর একেক জেলায় আহমদিয়াদের কেন্দ্রে আয়োজন করেন তারা। নিরাপত্তার কারণে এভাবে তারা সালানা জলসার আয়োজন করে থাকেন। এটা শুধু পঞ্চগড়ের নয়, সারাদেশের প্রশাসনের জানা থাকা জরুরি।

আহমদিয়া জামায়াত নিজেদেরকে ইসলাম ধর্মের অনুসারী মনে করে। মুসলমানদের একটি অংশ মনে করে, তারা ইসলামের উপধারার অনুসারী, আরেকটি অংশ তাদেরকে মুসলমান হিসেবে স্বীকার করে না। যা ধর্মীয় বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। এ নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্ক হতে পারে। এসব বিষয়ে আমাদের দীর্ঘ ধর্মীয় আলাপ, বিতর্ক, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার ইতিহাস আছে। ধর্মীয় তাত্ত্বিক আলাপ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির বিষয় নিয়ে আলোচনা ধর্মীয় পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের কাজ। উগ্র সংগঠনের প্রচারণায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে হামলায় অংশ নেওয়া কোনো মুসলমানের জন্য তার ধর্মের নির্দেশ হতে পারে না। এমন কাণ্ডকে ইসলাম বরাবরই নিরুৎসাহিত করে। এগুলো অনৈসলামিক কাণ্ড।

ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও তাত্ত্বিক আলাপের নিরিখে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আহমদিয়াদের সালানা জলসা আয়োজনের অধিকারের বিষয়টি কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন হওয়ার সুযোগ নেই। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসের কিছু অমিল হওয়ায় কোনো সম্প্রদায়কে জলসা করতে না দেওয়া, তাদের বাড়িঘরে হামলা চালানো, হত্যা করা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য কাজ হতে পারে না। আইনিভাবে নয়, ধর্মীয়ভাবেও নয়। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধান অনুযায়ী আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি। প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্ম পালন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সেখানে নিশ্চিত করা আছে। উগ্রগোষ্ঠীগুলোর এসব হামলা আসলে দেশকে জঙ্গিবাদের শিকারে পরিণত করার গভীর পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্রের অংশ।

শেয়ার করুন