চীনের ঋণের ফাঁদের শঙ্কা উড়িয়ে দিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। ছবি : সংগৃহীত

চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ার শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, ‘চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা কখনোই হবে না। চীনের ঋণের ফাঁদে পড়া নিয়ে মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা আছে। আমরা এই ধরনের আলোচনা এড়িয়ে চলি। আমরা জাপানের কাছ থেকেও অনেক ঋণ নিই, কিন্তু কিছু তো হচ্ছে না।’

শনিবার (১১ মার্চ) বাংলাদেশ বিজনেস সামিটের একটি অধিবেশনে সিএনএন সুপরিচিত সাংবাদিক এবং এডিটর–অ্যাট–লার্জ রিচার্ড কোয়েস্টের সঙ্গে কথোপকথনে অংশ নেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

universel cardiac hospital

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানের শুরুতেই রিচার্ড কোয়েস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন, বাংলাদেশ চীনের ঋণের ফাঁদে পড়তে পারে। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী? এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই উত্তর দেন। এরপর তিনি বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে একই বিষয়ে জানতে চান। জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘আমি ওনার (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) সঙ্গে পুরোপুরি একমত। এটি নিয়ে আমি চিন্তিত নই।’

‘তাহলে আপনি কী নিয়ে চিন্তিত?’ এরপরই রিচার্ড কোয়েস্ট এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেন বাণিজ্যমন্ত্রীর দিকে। জবাবে টিপু মুনশি বলেন, আমরা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে চিন্তিত। এই যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে আমাদের চ্যালেঞ্জ বাড়বে।

অবশ্য অনুষ্ঠানের প্রথম প্রশ্নই ছিল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে। রিচার্ড কোয়েস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান কী? বাংলাদেশ তো জোটনিরপেক্ষ দেশ (নন–অ্যালাইন কান্ট্রি) হিসেবে পরিচিত। এই বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী উত্তর দেন, ‘আমরা একটি কঠিন অবস্থানে আছি। আমাদের মূলনীতি হলো, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। আমাদের মূল্যবোধ হলো, আমরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আমরা একটি শান্তিপূর্ণ দেশ। আমরা জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশ নিই।’

এরপরেই রিচার্ড কোয়েস্ট প্রশ্ন করেন বাণিজ্যমন্ত্রীকে। এবারের প্রশ্ন, ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে? ব্যবসায় পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে কি না? বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘নানা চ্যালেঞ্জ আছে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও রপ্তানি বাড়ছে। আমরা কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা করছি। ইতিমধ্যে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ চিন্তায় আছে। আমরা এ নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

নির্বাচন প্রসঙ্গ

ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির পর আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি আনেন রিচার্ড কোয়েস্ট। তিনি বলেন, সামনের বছর জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে আপনাদের চিন্তাভাবনা কী? জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা গত ১৪ বছরে অবিশ্বাস্য উন্নয়ন করেছি। সব শ্রেণির মানুষ এই সরকার নিয়ে খুশি। এই সময়ে এই সরকার এক হাজারটির মতো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করেছি। ভোটারদের ছবিসংবলিত পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স দিয়ে নির্বাচন হয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনও সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে বলে আশা প্রকাশ করছি।’

‘বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিয়ে কী ভাবছেন?’ সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্ন করেন রিচার্ড কোয়েস্ট। জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এই প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সবাইকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা কখনোই তাদের নিষেধ করিনি (ডিসঅ্যালাউড করিনি)। তবে তাদের অবশ্যই সংবিধান ও প্রচলিত আইনকানুন মেনে চলতে হবে। মানুষকে আগুনে পোড়ানো, মানুষের সম্পদ ধ্বংস করা—এগুলো আমরা বরদাস্ত করি না। যদি আলোচনার টেবিলে আসতে চাইলে অবশ্যই স্বাগত জানাই।’

‘তাহলে কি আপনারা নির্বাচনে লড়াই করতে চাইছেন?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই।’

রিচার্ড কোয়েস্ট এবার প্রশ্ন করেন, ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন, অনেকের ধারণা, আপনারা কর্তৃত্ববাদী ও গণতন্ত্রবিরোধী হয়ে গেছেন নাকি দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে আপনাদের উদ্যম হারিয়ে যাচ্ছে? এগুলো কি ভোটের ওপর প্রভাব ফেলবে? এই বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনে আমাদের জনগণ সঠিক লোককে ভোট দেবেন।’

দুই মন্ত্রীর কাছে রিচার্ড কোয়েস্টের সর্বশেষ প্রশ্ন ছিল, পাঁচ বছর পর বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান? উত্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, এখন ছয় হাজার কোটি ডলারের রপ্তানি আয় হয়। এটি ১০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, পাঁচ বছর পর দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ হবে।

বাংলাদেশের সম্ভাবনা

কথোপকথন অনুষ্ঠানের আগে বাংলাদেশ ও সিএনএন নিয়ে দুটি উপস্থাপনা দেওয়া হয়।

সিএনএনের শীর্ষ কর্মকর্তা টিনি সেবক বলেন, তিনটি খাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা আছে। এগুলো হলো, টেকসই উন্নয়ন খাত, তথ্যপ্রযুক্তি ও সরবরাহ খাত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, আগামী অর্থবছরে মাত্র ২০টি দেশে ১ শতাংশের কম মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে। তবে বাংলাদেশ ভালো করবে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। কোভিডের মধ্যেও বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন হয়েছে। এখন ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি আছে। তৈরি পোশাক ও কৃষিতে বাংলাদেশ অবিশ্বাস্য সাফল্য দেখিয়েছে। এখন নতুন স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে।

আরেক কর্মকর্তা রব ব্রেডলে বলেন, ‘মানুষ প্রথমে ব্র্যান্ড দেখে। তারপর ওই পণ্যের দাম দেখে। তবে কোভিডের কারণে ভোক্তার এই আচরণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তিনি আরও বলেন, সিএনএনের ৭৮ উপাদান (কনটেন্ট) মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ। আমরা দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্ট বানাই। এই ক্ষেত্রে আমরা ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের কনটেন্ট বানিয়ে থাকি। কারণ, ৬৯ মানুষ ব্র্যান্ড পণ্যের জন্য বাড়তি অর্থ খরচ করতে রাজি।’

দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য প্রদর্শন, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্য নিয়ে তিন দিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ ব্যবসা সম্মেলন ২০২৩’ শনিবার শুরু হয়েছে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিজেদের সংগঠনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই সম্মেলন আয়োজন করছে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। এ আয়োজনে সহযোগিতা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।

এই সম্মেলনে যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, চীন, ভুটান, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ৭টি দেশের মন্ত্রী, ১২টি বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহীসহ ২ শতাধিক বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধি অংশ নিচ্ছেন। সম্মেলনের জন্য সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে সাত শ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ নিবন্ধন করেছেন।

এফবিসিসিআই আশা করছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে এই সম্মেলন ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি নতুন ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টিতে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে।

তিন দিনের সম্মেলনে বিনিয়োগের সম্ভাব্য খাত যেমন অবকাঠামো, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন, পোশাক ও বস্ত্র, ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি নিশ্চয়তা, কৃষি ব্যবসা, অটোমোবাইল, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে ১৭টি অধিবেশন হবে।

শেয়ার করুন