আধুনিক যুগের রাষ্ট্র গঠিত ও পরিচালিত হয় রাজনীতির প্রক্রিয়ায়, যেখানে রাষ্ট্রকে প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সামন্ত একনায়কতান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং তাদের কল্যাণে পরিচালনা করার দর্শন বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছে। এ কারণে আধুনিক যুগের রাষ্ট্র নির্মাণে রাজনীতি অপরিহার্য ভাবাদর্শ হিসেবে সবার কাছেই বিবেচিত হচ্ছে। জনগণ আধুনিক যুগের রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমে তাদের মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে পারে। সে কারণেই রাষ্ট্র দ্রুত এর চরিত্র পরিবর্তন করতে পেরেছে। আধুনিক রাষ্ট্র এখন জনগণকে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ সব মৌলিক অধিকারের যেমন শর্ত পূরণ করে, উন্নত জীবন প্রদানেরও নিশ্চয়তা বিধান করে। রাজনীতিকে বন্ধ করে দিয়ে কোনো সমাজ আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না। সে কারণে বলা হয়ে থাকে, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, জীবনব্যবস্থা এবং মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ ও বিকাশের গ্রহণযোগ্য পথ হচ্ছে রাজনৈতিক উপায়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। রাজনীতির কোনো বিকল্প ব্যবস্থা আধুনিক রাষ্ট্রে কল্পনা করা যায় না।
পরাধীনতার যুগে স্বাধীনতার জন্য যেসব আন্দোলন আত্মত্যাগ আমাদের পূর্বপুরুষরা করেছেন তা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই করা হয়েছিল। রাজনীতিই শেষ পর্যন্ত আমাদের ঔপনিবেশিকতার বেড়াজাল ছিন্ন করে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। আমরা রাজনীতির জটিল অভিজ্ঞতায় তখনো পোক্ত হয়ে উঠতে পারিনি বলেই পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পাকিস্তান গঠিত হওয়ার মুহূর্তেই আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠি। পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরাচারী শাসন আমাদের রাজনৈতিক বোধকে নানা অভিজ্ঞতায় শাণিত করেছে। আমাদের এই অঞ্চলে নানা রাজনৈতিক দলের জন্ম হলেও আওয়ামী লীগসহ আরো কয়েকটি দল পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক অধিকার, স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক মুক্তি ইত্যাদি লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়েছিল। আওয়ামী লীগ এই সংগ্রামে জোরালোভাবে নেতৃত্ব প্রদান করতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে আওয়ামী লীগ রাজনীতির নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। পূর্ব বাংলার জনগণের জাতিগত অধিকারের প্রশ্নে যারা একমত পোষণ করে তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। আওয়ামী লীগ জনগণের মধ্যে এর সাংগঠনিক ভিত্তি ও রাজনীতি তখনই সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়। ষাটের দশকে দলটি পূর্ব বাংলার জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়, অন্য দলগুলো পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি অন্ধ থাকার কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ছয় দফা উত্থাপনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের যে পথ রচনা করেন, তা ছিল রাজনীতির এক কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়। আওয়ামী লীগ দলগতভাবে এ কারণে সামরিক শাসকদের রোষানলে পড়েছিল, নেতাদের বেশির ভাগই জেলে ছিলেন। অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারা ভয় পেয়েছিলেন। সেই রাজনীতির সীমাবদ্ধতা দলগুলোকে সম্পূর্ণরূপে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রের রোষানলে পড়লেও জনগণের মধ্যে যে রাজনৈতিক বোধ সৃষ্টি করতে পেরেছিল সেটি দলটিকে আরো শক্তিশালী করেছিল। ফলে বন্দি শেখ মুজিব এবং অন্য নেতাদের মুক্ত করার জন্য গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা ক্ষমতার হাতবদল করতে বাধ্য হলো, শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দিতেও বাধ্য হয়েছিল। শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন রাজনীতির এক প্রাণপুরুষ। অন্যদিকে যাঁরা ভুল রাজনীতি করেছিলেন তাঁরা নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
শেখ মুজিব জনগণের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হলেন। রাজনীতিকে তিনি নতুন উচ্চতায় টেনে নিয়ে গেলেন, সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক পরিচয়কে চ্যালেঞ্জের মুখ ফেলে দিলেন, অগ্রসর হলেন ছয় দফার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মেনিফেস্টো নিয়ে। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সেটি গ্রহণ করতে পারেনি, সেটি তাদের অক্ষমতা, অযোগ্যতা ও অদূরদর্শিতা। বঙ্গবন্ধু সেই প্রেক্ষাপটে আপসহীনভাবে এগিয়ে গেলেন, পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুকে পিছিয়ে দিতে চাইল। গণহত্যাসহ বর্বরোচিত উপায়ে পূর্ব বাংলাকে দমন করতে চেয়েছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণ রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করার মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল রাজনৈতিক আন্দোলন, সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের এক সফল পরিণতি। তবে দেশি ও বিদেশি অপশক্তির ষড়যন্ত্রে দেশে ১৫ আগস্ট বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে। রাজনীতির ওপর নেমে আসে মস্ত বড় আঘাত। তাতে শুধু রাজনীতিই পথ হারায়নি, বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রকেও পশ্চাত্মুখী অপশক্তির রাজনীতিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
সামরিক শাসন একবার নয়, ধারাবাহিকভাবে দুইবার রাষ্ট্রক্ষমতা ১৫ বছর বেদখল করে রাখল। তখনো চেষ্টা করা হয়েছিল রাজনীতিকে আবার আপন মহিমায় ফিরিয়ে আনার জন্য। এমনকি সাম্প্রদায়িক শক্তি ও সামরিক বাহিনীর পরিকল্পিত উপায়ে গঠিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ বাম দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে টানা প্রায় আট বছর। কিন্তু সামরিক শাসনের অবসান ঘটার পর নির্বাচনে গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটলেও রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের আদর্শের ধারার পুনরুজ্জীবন ঘটেনি, রাষ্ট্রে সংসদীয় গণতন্ত্রের সংসদ ফিরে এলেও সংসদীয় রাজনীতির চর্চা ফিরে আসেনি।
২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগকে নতুনভাবে নিশ্চিহ্ন করার বড় বড় ষড়যন্ত্র রাজনীতির মাঠে পোঁতা হয়। রাজনীতি তখন সত্যিকার অর্থেই রাজনীতিবিদদের জন্য জটিল হয়ে যায়। রাজনীতি থেকে হারিয়ে যান অনেক ত্যাগী রাজনীতিবিদ এবং আদর্শের রাজনীতিও। এর পরও ২০০৮ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি আবার আপন জায়গায় ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার দিনবদলের সনদ এবং রূপকল্প-২০২১ প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক ধারায়ও ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সে উদ্যোগ বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। রাজনীতিতে একটি ওলটপালট আদর্শিক দন্দ্ব সম্মুখে চলে আসে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য সব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করার চেষ্টা হয়েছিল। এর পরও বলা চলে দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যতটুকু অর্জন তার সবটুকুই এসেছে উদারবাদী শক্তির কল্যাণে। শ্রমজীবী, কৃষক, প্রবাসী, শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির ব্যাপক সম্প্রসারণও ঘটেছে রাজনীতির হাত ধরেই।
কয়েক মাস পর দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতি আবার পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে যেন মল্লযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু রাজনীতি তো শুধু ক্ষমতায় যাওয়া আর থাকার বিষয় নয়। এটি জনগণের কল্যাণকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য একটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে মল্লযুদ্ধের প্রস্তুতি নয়, বরং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের মহাপরিকল্পনা কে কিভাবে কতটুকু নিতে চায়, দিতে সক্ষম হবে, সেটি জনগণের সামনে তুলে ধরা বিশাল এই জনঘনবসতিপূর্ণ দেশটির জন্য এখন একান্তই প্রয়োজন। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনীতির যথার্থ প্রতিফলন ঘটানো, অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি শিক্ষা ও সংস্কৃতির মানও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তবেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের জনগণের অস্তিত্ব শুধু টিকেই থাকবে না, বিকশিতও হবে। এখন সেই রাজনীতিই দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।
লেখক : ইউজিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফেলো ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়