ফিরিয়ে আনা হবে আরাভ খানকে, কীভাবে দেশত্যাগ খতিয়ে দেখছে পুলিশ

মত ও পথ ডেস্ক

আরাভ (বর্তমান), পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান ও আরাভ (পূর্বের লুক)। সংগৃহীত ছবি

গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার যুবক রবিউল ইসলাম নিজের নাম, জাতীয়তা পরিবর্তন করে জোগাড় করেন ভারতীয় পাসপোর্ট। আর এই পাসপোর্টেই পাড়ি জমান সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। দুবাই পাড়ি জমিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন ‘আলাদিনের চেরাগ’।

দুবাইয়ে তার স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ও চলচ্চিত্র তারকাদের আমন্ত্রণ নিয়ে কয়েক দিন ধরেই চলছে নানা গুঞ্জন। ‘আরাভ জুয়েলার্স’ নামের ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম আরাভ খান। মূলত তিনি বাংলাদেশের নাগরিক রবিউল ইসলাম। তবে ভারতে গিয়ে নাম পরিবর্তন করে রাখেন আরাভ খান।

পুলিশ বলছে, এই আরাভ খানই মূলত ঢাকার স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম। তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এছাড়া তিনি কীভাবে দেশত্যাগ করলেন সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।

দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর সম্প্রতি আলোচনায় আসেন আরাভ। বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে দিয়ে দুবাইয়ে তার শোরুম উদ্বোধন করা হবে- এই ঘোষণার মাধ্যমে আলোচনায় আসেন। কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিরো আলমকেও দুবাইয়ে নেওয়ার আমন্ত্রণ জানান তিনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণাটি ছড়িয়ে পড়ার পর নড়েচড়ে বসেন গোয়েন্দারা। দীর্ঘদিন ধরে যাকে খোঁজা হচ্ছিল তিনি দুবাইয়ে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ‘আরাভ জুয়েলার্স’ নামে সোনার দোকান দিতে যাচ্ছেন। কিনেছেন বাড়ি-গাড়ি। দুবাইয়ে রয়েছে তার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।

দুবাইয়ের নিউ গোল্ড সুকে উদ্বোধন করা হয়েছে আরাভ জুয়েলার্সের। কয়েক দিন আগে এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের খ্যাতিমান তারকাদের সম্ভাব্য উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন রবিউল ওরফে আরাভ। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা টাওয়ারের ৬৫ তলায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। যার নম্বর ৬৫১০। আরও ৪-৫টি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। পাশাপাশি রয়েছে একটি সুইমিংপুল ও বাগানসহ বড় ডুপ্লেক্স বাড়িও।

তার ওই ফেসবুক পোস্ট দেখে অনেকেই চিনে ফেলেন, তিনি বাংলাদেশে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম। ফেরারি এক আসামি দুবাইয়ে গিয়ে কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন, তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।

এরপর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, পুলিশের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার টাকায় দুবাইয়ে সোনার ব্যবসা শুরু করেন রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান।

দুবাইয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পাওয়া একজন বাংলাদেশি। কারণ এর আগে কোনো বাংলাদেশি দুবাই গিয়ে এত বিলাসী জীবনযাপন করেছেন- এমনটি দেখেননি তারা।

যেভাবে খুন হন এসবির পুলিশ পরিদর্শক

২০১৮ সালের ৮ জুলাই বনানীর একটি বাসায় গিয়ে খুন হন পরিদর্শক মামুন ইমরান খান। পরদিন তার মরদেহ বস্তায় ভরে গাজীপুরের উলুখোলার একটি জঙ্গলে নিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

মামলার তদন্ত শেষে পরের বছরের এপ্রিলে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সেই অভিযোগপত্রে বলা হয়, রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে বিত্তবানদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করতো একটি চক্র। তাদের লক্ষ্য ছিল বিত্তবানদের আটকে অশালীন ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে টাকা আদায় করা।

রবিউলসহ ১০ জনকে আসামি করে ২০১৯ সালের এপ্রিলে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয় আদালতে।

মামুন হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে রবিউল ছাড়াও তার স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়াকে (২১) আসামি করা হয়। এছাড়াও নিহত মামুনের বন্ধু রহমত উল্লাহ (৩৫), স্বপন সরকার (৩৯), দিদার পাঠান (২১), মিজান শেখ (২১), আতিক হাসান (২১), সারোয়ার হোসেন (২৩) ও দুই কিশোরীকে আসামি করা হয়।

মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, রবিউল গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামের মতিউর রহমান মোল্লা এবং লাকি বেগমের ছেলে। ওই গ্রামটি উপজেলার হিরন ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত।

আয়নাবাজির মতো অন্যকে পাঠানো হয় কারাগারে
পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর রবিউল ইসলাম নামের একজন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাকে জেলে পাঠান। প্রায় ৯ মাস কারাবাসের পর ওই তরুণ বলেন, তিনি রবিউল ইসলাম নন, তার আসল নাম আবু ইউসুফ। রবিউল ইসলামের কথামতো তার নাম-পরিচয় ব্যবহার করে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তিনি।

এরপর আদালত বিষয়টি অনুসন্ধান করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) প্রতিবেদন দিতে বলেন।

ডিবির অনুসন্ধানে জানা যায়, খুনের মামলার আসামি রবিউলের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মতিউর রহমান। আর রবিউলের পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণকারী আবু ইউসুফের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার আইনপুর গ্রামে। তার বাবা নুরুজ্জামান, মা হালিমা বেগম।

গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) শাহিদুর রহমান রিপন বলেন, জুয়েলার্সের মালিক আরাভ খানই এসবির পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যার আসামি। তার আসল নাম রবিউল ইসলাম। তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতে সোপর্দ করার চেষ্টা চলছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ইন্টারপোলের মাধ্যমে খুনি আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামকে গ্রেফতারের জন্য অনুরোধ করবো। তাকে দেশে ফেরত আনা হবে। এছাড়া তিনি কীভাবে দেশ ত্যাগ করলেন সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।

এদিকে, বাংলাদেশ সময় রাত ১০টার দিকে সাকিব আল হাসানকে জুয়েলারি শপটি উদ্বোধনের জন্য সেখানে যেতে দেখা গেছে। দেশি-বিদেশি শিল্পীদের উপস্থিতিতে উদ্বোধন হয় হত্যা মামলার পলাতক আসামি রবিউল ওরফে আরাভের জুয়েলারি শপ।

শেয়ার করুন