নাম আরাভ খান। দুবাইয়ের সোনা ব্যবসায়ী। তবে তার এই নামের আড়ালেও আছে আরও নাম, পরিচয়ের আড়ালেও আছে পরিচয়। নানা সময়ে নিজে যেমন বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছেন, আবার একাধিক দেশের নাগরিকত্বও অর্জন করেছেন।
জানা গেছে, ভিন্ন আটটি নামে অন্তত পাঁচ দেশের নাগরিকত্ব রয়েছে এই জুয়েলারি ব্যবসায়ীর। গোয়েন্দা পুলিশের ধারণা, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খানকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার আসামি এই আরাভ খানই পলাতক রবিউল ইসলাম।
আরাভ নামে এই ব্যক্তি বাংলাদেশ, ভারত ও দুবাইয়ে ব্যাপক পরিচিত। সম্প্রতি দুবাইয়ের গোল্ড সুক এলাকায় নিজের নামে জুয়েলারি শপের উদ্বোধন অনুষ্ঠান ঘিরে নতুন করে আলোচনায় আরাভ। অথচ তার নামে রয়েছে খুনের ঘটনার মতো একাধিক অপরাধের অভিযোগ। ঢাকায় পুলিশ হত্যা মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে চলে যান কলকাতায়। পাল্টে ফেলেন নিজের নাম। যেখানে গেছেন সেখানেই নতুন নামে পরিচিত হয়েছেন। কখনো তিনি আপন আহমেদ, কখনো সোহাগ, কখনো রাশেদুল ইসলাম, আপন মোল্লা, হৃদি শেখ, হৃদয়, রবিউল ইসলাম ও কখনোবা আরাভ খান।
শুধু নাম পরিবর্তন করেননি ৩০ বছরের এই যুবক। নামের সঙ্গে নাগরিকত্বও বদলেছেন। শুধু আরাভ আর রবিউল নয়, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রাম কিংবা কলকাতাও নয় তার জাতীয় পরিচয়পত্র করা হয়েছে বাগেরহাটেও। এখন পর্যন্ত জানা গেছে, আট নামে বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত (দুবাই), কানাডা, ফ্রান্স এই পাঁচ দেশের নাগরিকত্ব রয়েছে তার। এই পাঁচ দেশই যেন তাকে আইনের আওতায় আনতে সহায়তা করে সেজন্য তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ জারি করতে যাচ্ছে রেড অ্যালার্ট। এরইমধ্যে রেড অ্যালার্ট জারি করতে পুলিশ সদরদপ্তর উদ্যোগ নিয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগ থেকে রেড অ্যালার্ট জারির খসড়া তৈরি করা হয়। সেই খসড়া চূড়ান্ত করে সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ১১ পর্যন্ত পুলিশ সদরদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা নথিপত্র চূড়ান্ত করে। এই ফাইল অনুমোদন পেলেই আরাভ খানের বিরুদ্ধে জারি হয়ে যাবে রেড অ্যালার্ট।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে বনানীতে খুন হন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান। এ ঘটনায় ওই বছরের ১০ জুলাই মামুনের ভাই ঢাকার বনানী থানায় মামলা করেন। এ মামলায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এই হত্যা মামলার ৬ নম্বর পলাতক আসামি আরাভ খান।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, আরাভের আসল নাম রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয়। পুলিশের জমা দেওয়া অভিযোগপত্রেও তাকে পলাতক আসামি দেখানো হয়েছে। মামলায় বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) খেলার সুযোগ করে দেওয়ার প্রলোভনে আরাভের বদলে আবু ইউসুফ লিমন নামের এক তরুণকে কারাগারেও পাঠানো হয়েছিল। পরে জানাজানি হলে আদালত লিমনকে খালাস দেন। এ ঘটনায় আরাভ খানকে ডিবি পুলিশেও ডাকা হয়েছিল। অবশ্য পরে পাসপোর্টে নাম পরিবর্তন করে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। বনে যান কোটি কোটি টাকার জুয়েলারি শপের কর্ণধার।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গত বুধবার (১৫ মার্চ) তার জুয়েলারি শপ ‘আরাভ জুয়েলার্স’ উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে ফের আলোচনায় আসেন পুলিশ খুনের মামলার পলাতক আসামি আরাভ। সেই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও ইউটিউবার হিরো আলম ছিলেন।
গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি আমলে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার তদন্ত করছে ডিবি। ওই তদন্তে মামলার এজাহারভুক্ত ৬ নম্বর পলাতক আসামি আরাভ খান ওরফে আপন আহমেদ ওরফে সোহাগ ওরফে রাশেদুল ইসলাম ওরফে আপন মোল্লা ওরফে হ্দি শেখ ওরফে হৃদয় ওরফে রবিউল ইসলাম। এসব নামে পাসপোর্ট রয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
এমন ধারণা থেকে বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) ডিবির মতিঝিল বিভাগ থেকে পুলিশ সদরদপ্তরে রেড অ্যালার্ট জারির নোটিশের খসড়া তৈরি করে, যা পুলিশ সদরদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তর থেকে এই রেড অ্যালার্টটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে ইন্টারপোলের মাধ্যমে জারি করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. মনজুর রহমান জানিয়েছেন, পুলিশ পরিদর্শক হত্যা মামলার একজন আসামি আরাভ খান। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তদন্ত শুরু করেছেন। তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এর আগে দুবাইয়ের আলোচিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছে পুলিশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরাভ খানই মূলত স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম।
শুধু আরাভ আর রবিউল নয়, আবার গোপালগঞ্জ কিংবা কলকাতাও নয়- তার জাতীয় পরিচয়পত্র গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রাম ছাড়াও নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র মিলেছে বাগেরহাট জেলার ঠিকানায়। সেই পরিচয়পত্রে নাম রয়েছে রবিউল ইসলাম, বাবা মতিউর রহমান, মা লাখি ও স্ত্রী রুমা। পরিচয়পত্রটিতে ১৯৮৭ সালের ১৯ আগস্ট বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলার আড়ুয়াডিহিতে জন্ম লেখা রয়েছে। শরীরের বিশেষ চিহ্নসহ রক্তের গ্রুপ দেওয়া আছে সেই জাতীয় পরিচয়পত্রে। আর পেশা হিসেবে লেখা রয়েছে ব্যবসায়ী।
পরিদর্শক মামুন ইমরান খানকে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় বর্তমানে দিদার নামের এক আসামি কারাগারে রয়েছেন। জামিনে মুক্ত রয়েছে রহমত উল্লাহ, স্বপন সরকার, মিজান শেখ, আতিক ও সারোয়ার নামের ৫ আসামি। আর পলাতক রয়েছেন রবিউল ইসলাম আপন ও সুরাইয়া আক্তার।
বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে এসে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয় দাবি করেছেন দুবাইয়ের জুয়েলারি ব্যবসায়ী আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম। তিনি বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে একটি মামলা চলমান রয়েছে। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমি জড়িত নই। আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না। মামলায় আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। যে অফিসে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে সেই অফিসের মালিক আমি ছিলাম বলেই আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমি এটা মোকাবিলা করতে রাজি আছি, এমন নয় আমি লুকিয়ে যাবো, পালিয়ে যাবো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ডাকলে ও সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস পেলে দেশে ফিরতে রাজি আছি। আদালতই বলে দেবেন কী বিচার হবে আমার। দোষী হলে সাজা মাথা পেতে নেবো।
তিনি বলেন, স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকেই আমাকে ওপরে উঠতে দিচ্ছেন না। আমাকে দুদিন আগেও কেউ চিনতো না। মানুষের বিপদ তো সারাজীবন থাকে না, অবশ্যই একদিন না একদিন কেটে যাবে। আমি ডিসকাউন্টে গ্রাহকদের কাছে স্বর্ণ পৌঁছে দেবো, এমন ঘোষণা দিয়েছিলাম। সে ঘোষণাই আমার কাছে কাল হয়েছে। স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ আমার বিপরীতে রয়েছেন।