১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, নয় মাস পর্যন্ত চলে তাদের সেই বাঙালি নিধনযজ্ঞ, যা আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুসারে নিঃসন্দেহে গণহত্যা। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা গণহত্যার যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে, অর্থাৎ যে ধরনের নৃশংস উপাদান থাকলে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, এর সবই বিদ্যমান পাকসেনা ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের একাত্তরে বাঙালি নিধনযজ্ঞে।
১৯৪৮ সালে গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় উল্লেখিত সংজ্ঞা বলছে, কোনো জাতি, ধর্মীয়গোষ্ঠী কিংবা বর্ণ বা নৃগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে ধ্বংসের লক্ষ্যে যে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়, তা গণহত্যা। সেখানে কোনো গোষ্ঠীর সদস্যরা নিজের ব্যক্তিগত ভূমিকার কারণে যতোটা, এর চেয়ে বেশি গোষ্ঠীগত পরিচয়ের কারণে আক্রমণের শিকার হন। নিরীহ বাঙালি একাত্তরে গণহত্যার শিকার হয়েছিলো তাদের বাঙালি পরিচয়ের কারণেও।
রাষ্ট্রপিতা ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তনয়া ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবে ২৫ মার্চের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলে। আমাদের মধ্যে তখন এই আকুতিও ছিল, ২৫ মার্চের গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করুক। জাতিসংঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করুক। সারাবিশ্ব জানুক, মুক্তিযুদ্ধকালে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীর ইসলাম ধর্মের নামে গণহত্যা, ধর্ষণসহ যুদ্ধাপরাধের কথা। গত আট বছরের মধ্যে সেটা ঘটেনি। ২৫ মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কথিত ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচালিত অভিযানে হাজারো বাঙালিকে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় হত্যা করার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কেন বাংলাদেশ পাচ্ছে না, সেটি একটি প্রশ্ন। সিয়েরালিওন, আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডার মতো ছোট দেশ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে পেরেছে। বাংলাদেশও তা পারবে। সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। তবে পাকসেনাদের গণহত্যা যেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পায়, এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সক্রিয় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী।
কারণ, ২৫ মার্চের ভয়াল সেই রাতে ঢাকায় গণহত্যার নির্দেশদাতা থেকে শুরু করে যারা গুলি চালিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধী। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলে তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ও গণহত্যার ঘটনা বিশ্ববাসীকে ভুলতে না দেওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব আরো বেড়ে যাবে। তাদের বিচারের জন্য তখন আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের ধর্মের নামে নারী ধর্ষণ, নির্যাতন, সংখ্যালঘুদের সম্পদ লুটপাট, তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগানোর ঘটনাগুলো পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষ জানবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করে সরকার দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম শুরু করলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠী তা বন্ধ করতে একইভাবে দেশ-বিদেশে সক্রিয় হয়। বিচার বন্ধ করতে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করে। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণার পাশাপাশি একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য একটি বিল পাস হয়। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে কাজে সংশ্লিষ্টরা গত আট বছরে প্রত্যাশিত গতি আনতে পারেননি।
গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য প্রথম ধাপ হিসেবে বিভিন্ন দেশের সংসদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করাতে হয়। এ ধাপের কার্যক্রমে গতি আসেনি। সেজন্য যে জোরালো ও শক্তিশালী কূটনীতি দরকার ছিলো, তা সংশ্লিষ্টরা দেখাতে পারেননি। একাত্তরে পাক হায়েনাদের বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদ ও নিন্দা করেছিলো যেসব বন্ধুরাষ্ট্র, তাদের অনুরোধ করলে নিজ দেশের সংসদে প্রস্তাব পাস করবে বলে আমরা মনে করি। অবশ্য বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
২৫ মার্চের গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রেকর্ডে স্বীকৃতি থাকাও জরুরি। এ ক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে আছি। ইম্পেরিয়াল ওয়্যার মিউজিয়ামসহ পৃথিবীর বিভিন্ন আর্কাইভে গণহত্যার তথ্য নানা কারণে তুলে ধরা যায়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন সেই গণহত্যার অসংখ্য তথ্য-প্রমাণ এখনো রয়ে গেছে। সেসব সংগ্রহ ও গ্রন্থিত করে বিশ্ব পরিসরে তুলে ধরার কাজ অত্যন্ত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে করতে হবে।
বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধান দেয়ার জন্য ২৫ মার্চের গণহত্যার নির্মম ইতিহাস আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। দক্ষ কূূটনীতির সঙ্গে প্রয়োজনীয় উদ্যেগ নিলে সেটা অবশ্যই সম্ভব বলে আমরা মনে করি। সেটা করতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ব্যর্থতাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করবে। পাকিস্তানিদের ওই বর্বরতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে নতুন করে জানানো প্রয়োজন।
বিশ্বমানবতার অগ্রযাত্রার স্বার্থে গণহত্যার মতো নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবির প্রতি বিশ্ববাসী সমর্থন জানাবে ও জাতিসংঘ পদক্ষেপ নেবে এবং নৃশংসতার জন্য দায়ীদেরকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবে- আজকের দিনে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।