নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুই দিনব্যাপী মহাষ্টমী স্নানোৎসব ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) রাতে স্নানের লগ্ন শুরু হলেও বুধবার (২৯ মার্চ) ভোর থেকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তীর্থস্থানে পুণ্যার্থীদের ভিড় বাড়ছে চোখে পড়ার মতো।
এবার দেশ-বিদেশ থেকে আসা প্রায় ১০ লাখ মানুষ পুণ্যস্নানে অংশ নেবেন বলে ধারণা পূজা উদযাপন পরিষদের। এ বছর মঙ্গলবার রাত ৯টা ১৭ মিনিটে তিথি শুরু হয়ে বুধবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে স্নানের সময় শেষ হবে।
জাতীয় মহাতীর্থ স্নানোৎসব কমিটির সূত্রে জানা গেছে, এবার আনুষ্ঠানিকভাবে লাঙ্গলবন্দে মোট ১৮টি ঘাটে পুণ্যস্নানের আয়োজন থাকলেও ভক্তবৃন্দের অতিরিক্ত চাপের কারণে নির্মাণাধীন আরও ৩টি ঘাট স্নানের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে স্নানোৎসবকে ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। নিরাপত্তার কাজে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে কাজ করছে জেলা পুলিশ। এছাড়া আনসার বাহিনীর সদস্যরাও ঘাটগুলোতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করছেন। অপ্রীতিকর ঘটনা ও দুর্ঘটনা এড়াতে প্রতিটি ঘাটে ফায়ার সার্ভিসের চারজন সদস্য নিয়োজিত রয়েছে এবং ব্রহ্মপুত্র নদে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের একটি টহল বোট সার্বক্ষণিক টহল দিচ্ছে।
নরসিংদী থেকে পুণ্যস্নানে অংশ নেওয়া অর্পিতা আচার্য বলেন, মূলত ভগবান পরশুরাম এখানে স্নানের মাধ্যমে পাপমোচনের প্রথা সৃষ্টি করেছেন। এরপর থেকে পাপমোচন ও নতুন উদ্দীপনাকে ধরে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই এখানে জড়ো হন লাখ লাখ পুণ্যার্থী। আমি প্রত্যাশা করি এ দেশের সকল ধর্মের মানুষ এক হয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলবে।
সৌমেন শাহা নামের আরেক পুণ্যার্থী বলেন, রমজানের মাঝে এমন উৎসবমুখর পরিবেশে এবারের স্নানোৎসবের আয়োজন হবে ভাবিনি। নারায়ণগঞ্জ বরাবরই অসাম্প্রদায়িকতার স্বাক্ষর রেখেছে। আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, নারায়ণগঞ্জের মতো সারা দেশে সকল ধর্মের মানুষের মাঝে যেন এরকম সম্প্রীতি বজায় থাকে।
কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ও দুর্ঘটনা ঘটেনি জানিয়ে বন্দর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার মো. আব্দুল্লাহ হোসেন বলেন, গতকাল থেকেই এখানে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা কাজ করছেন। আমরা কোথাও কোনো ধরনের দুর্ঘটনার খবর পাইনি। এখানে আমাদের ৫০ জন সদস্য কাজ করছেন। ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থার চারটি অ্যাম্বুলেন্স এখানে রাখা হয়েছে। ডুবুরি দল ঘাটগুলোতে টহল দিচ্ছে। আশা করি সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে স্নানোৎসব সম্পন্ন হবে।
রমজানের মধ্যে হলেও এবারের আয়োজনে কোনো ঘাটতি নেই জানিয়ে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শিখণ সরকার শিপন বলেন, এবারের মহাষ্টমী স্নানোৎসবে ইতোমধ্যেই দেশ-বিদেশ মিলিয়ে ১০ লাখের বেশি পুণ্যার্থীর আগমন ঘটেছে। গতকাল রাতেই আট লাখ ভক্ত পুণ্যস্নানে অংশ নিয়েছেন। পুণ্যার্থীদের উপচে পড়া ভিড়ের কারণে জেলা প্রশাসনের অনুমতিক্রমে আগের ১৮টি ঘাটের সঙ্গে নতুন তিনটি ঘাট স্নানোৎসবের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সর্বাত্মক সহযোগিতায় এই আয়োজন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম কুদরাত এ খুদা জানান, সুষ্ঠুভাবে স্নানোৎসব সম্পাদনের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বন্দর উপজেলা প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। এবার পুণ্যস্নানের জন্য ১৮টি ঘাট সংস্কার করে নদের কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়েছে। পুণ্যার্থীদের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে ৪৭টি নলকূপ, এক শ অস্থায়ী টয়লেটসহ স্নানঘাটে কাপড় পাল্টানোর জন্য ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে প্রায় অর্ধশতাধিক মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব লাঙ্গলবন্দের মহাষ্টমী স্নানোৎসব সফল করতে এবং এখানে আগত ভক্তবৃন্দের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে আগত লক্ষাধিক পুণ্যার্থীদের জন্য তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। পুরো লাঙ্গলবন্দ এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে এবারের মহাষ্টমী স্নানোৎসব সম্পন্ন হবে বলে আমরা আশাবাদী।
প্রসঙ্গত, হিন্দু শাস্ত্রমতে দেবতা পরশুরাম হিমালয়ের মানস সরোবরে স্নান করে পাপমুক্ত হন। হিমালয়ের মানস সরোবরের পানি ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। প্রতি বছর চৈত্র মাসে পুণ্য লাভের আশায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জড়ো হন নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদে। সেখানে স্নান করে নিজেদের পাপমোচন করেন। সারা দেশের পাশাপাশি নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও অনেকে আসেন এই মহাষ্টমী স্নানোৎসবে।