বিভ্রান্তি ও ষড়যন্ত্রের বহুমুখী রূপ

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)
মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)। ফাইল ছবি

আজকাল পত্রিকায় কলাম লেখা প্রায় কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু পাঠকের নির্দয় অসৌজন্যমূলক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সৌজন্যবোধ যেন হারিয়ে না ফেলি তার জন্য সদা সতর্ক থাকতে হয়। আর যেহেতু বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করি, তাই এসবের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন কিছু দেখলে বা মনে হলে সোজাসাপ্টা কথা বলায় অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী সতর্ক করেন এই বলে যে সব কিছুতে ষড়যন্ত্র খোঁজার বাতিক নাকি ভালো নয়। তাঁদের সবিনয়ে বলি, রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কিত মানব ইতিহাস মানেই ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। ক্ষমতার মোহে পিতা-পুত্র পরস্পরকে এবং ভাই ভাইকে হত্যা বা ক্ষমতাচ্যুত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিতে আছে দেবতাদের রাজা ইউরেনাসকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁর ছেলে ক্রোনাস এবং ক্রোনাসকে হত্যা করে তাঁর ছেলে জিউস রাজা হন। আর মানবজগতে জুলিয়াস সিজার থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ দলের অতি বিশ্বাসী মানুষের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। একজন রাষ্ট্র পরিচালকের জনপ্রিয়তা ও সাফল্য যতই বেশি হবে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ডালপালা ততই বৃদ্ধি পাবে এবং বিস্তার ঘটবে। বঙ্গবন্ধুর বেলায় সেটাই হয়েছে।

এখন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। এই চলার যাত্রা আর কয়েকটি বছর একটানা চলতে পারলে তারপর বাংলাদেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে পাওয়া রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক মূল্যবোধই আজকের চলমান এই অগ্রযাত্রার মূল অবলম্বন ও শক্তি। তাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপরই আজ সবচেয়ে বেশি আঘাত আসছে। কেউ সাংবাদিক, কেউ ব্যবসায়ী, আবার কেউ বা পেশাজীবী—এসব ছদ্মবেশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের মৌলিক স্তম্ভ মুক্তিযুদ্ধের ওপর আঘাত করা হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে। আর আইনি ব্যবস্থা নিলে সেটিকে আইনিভাবে মোকাবেলা না করে অনবরত মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে এই বলে যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই, কথা বলার স্বাধীনতা নেই ইত্যাদি। গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বাধিয়ে দেওয়াই ষড়যন্ত্রকারীদের লক্ষ্য। আর সংঘাত বাধলেই তাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার জন্য তথাকথিত নিরপেক্ষরূপে হাজির হবেন, যেমনটি তাঁরা করেছিলেন ২০০৭-০৮ মেয়াদে। রাষ্ট্র ও সরকারের বাইরে থেকে বিভ্রান্তি তৈরি ও ষড়যন্ত্রের অপচেষ্টাকে যত না ভয় পাই, তার থেকে বেশি ভয় পাই ভেতরের চক্রান্তকে। এবং সেই ভয় আরো বৃদ্ধি পায় যদি দেখি অনেকেই বুঝে অথবা না বুঝে সেই বিভ্রান্তির জালে পা দিয়েছেন।

হুজুগে বাঙালি বলে একটা কথার প্রচলন আছে। আমরা বেশির ভাগই অন্যের কথার প্রতিধ্বনি করতে ভালোবাসি, আবার সেটি যদি ক্ষমতাবান কারো উক্তি হয়, তাহলে তো কথাই নেই। নিজেদের চিন্তাশক্তি ব্যবহার করতে ভুলে যাই, নতুন কিছু ভাবতে ভয় পাই; পাছে লোকে কিছু বলে। আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য এটাই। তবে তার আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বাসঘাতক মোশতাক নিজেদের মধ্যে কিভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন তার একটি উদাহরণ দিই। ‘ইতিহাসের রক্তপলাশ’ গ্রন্থে প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন। একাত্তরের নভেম্বর মাস। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরোক্ষ সর্বাত্মক সমর্থনে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র তৎপরতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সন্ত্রস্ত হয়ে একেবারে বাংকারের ভেতর আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অতি প্রয়োজন ছাড়া তারা বাংকার থেকে বের হয় না। এরই মধ্যে সর্বাত্মক সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি ভারতীয় সেনাবাহিনী শেষ করে ফেলেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সময় খন্দকার মোশতাক এক ভয়ানক চাল চাললেন। মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে মোশতাক পত্রিকায় ছাপানোর জন্য একটি বিবৃতি তৈরি করে গাফ্ফার চৌধুরীর কাছে পাঠিয়েছেন, যাতে সেটি যেন জয় বাংলা পত্রিকায় ছাপা হয়। তাতে ভারত সরকারকে উদ্দেশ করে লেখা হয়েছে, ‘যদি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে এখুনি স্বীকৃতি দেওয়া না হয়, তাহলে ভারতের মাটিতে আমাদের স্বাধীনভাবে মরার সুযোগ দেওয়া হোক।’ বিবৃতিটির মূলকথা দাঁড়ায়, ‘ভারত সরকার ইচ্ছে করে, অর্থাৎ উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুজিবনগর সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিচ্ছে না।’ মোশতাক অবিলম্বে এই স্বীকৃতি চান।

বিবৃতিটি পড়ে কারো মনে হতে পারে মোশতাকের মতো দেশপ্রেমিক বোধ হয় দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু এর গভীরে প্রবেশ করলেই বোঝা যাবে পাকিস্তানিদের কথারই প্রতিধ্বনি করছেন মোশতাক। অর্থাৎ স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা ভারতের লক্ষ্য নয়, এই অজুহাতে ভারত বাংলাদেশ দখল করে নিতে চায়। একেবারে পাকিস্তানিদের কথা মোশতাকের মুখ দিয়ে বের হয়েছে, একটু ঘুরিয়ে আর কি। বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে এমন সন্দেহমূলক বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিতে পারলে এবং তার সূত্রে যদি ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, তাহলে মোশতাকের লক্ষ্য পাকিস্তান রক্ষার একটা পথ বেরিয়ে যায়। এটাই ছিল মোশতাকের দুরভিসন্ধি। কিন্তু বিবৃতিটি গাফ্ফার চৌধুরী সংশোধন করে ছাপানোর ফলে সে যাত্রায় মোশতাকের দুরভিসন্ধি ব্যর্থ হয়। তখন মোশতাক গং আরো গুজব ছড়ায় এই মর্মে যে ইয়াহিয়া এখন শেখ মুজিবকে জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়, কিন্তু তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকার লোভে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো মিটমাট করতে চান না, বরং তিনি চান পাকিস্তানি জেলে মুজিবের মৃত্যু হোক এবং পাকিস্তান ভেঙে যাক (আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ‘ইতিহাসের রক্তপলাশ’, পৃ-১০০)।

পরবর্তী ইতিহাস এখন সবাই জানেন, তাতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে উপরোক্ত বিভ্রান্তি ছড়ানো ছিল বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ এবং সর্বৈব মিথ্যা। বাংলাদেশ যাতে কোনো দিন স্বাধীন হতে না পারে সেটাই ছিল মোশতাকের লক্ষ্য। স্বাধীনতার ৫২ বছরের মাথায় এসে মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকারের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী শত্রুর ষড়যন্ত্রের পুনরুল্লেখ করলাম এই কারণে যে এখনো রাষ্ট্রের ভেতর কত যে মোশতাক লুকিয়ে আছে তা কি কেউ জানে? আমরাও জানি না। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা দেখে সেই ঘরপোড়া গরুর মতো সিঁদুরে মেঘ দেখলেই আঁতকে উঠি। এবার ২৫ মার্চ রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করা হয়েছে। এটা শুরু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে। তার আগে ৪৪ বছরে এ কথা কারো মনে আসেনি। এ বছর দিবসটি পালন উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে পত্রিকায় একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে একজন পণ্ডিত ব্যক্তি একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তাতে একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা ও বর্বরতার কথা বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই নৃশংসতম গণহত্যার বিচার বাংলাদেশ চায়, বাংলাদেশের মানুষ চায়, আমরা সবাই চাই, তার কিছুই উল্লেখ নেই। তাহলে কি ধরে নিতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দাবি এখন আর আমরা করছি না। আমি জানি না।

৫২ বছরে পাকিস্তান একটিবারের মতো অনুতপ্ত হয়নি, দুঃখ প্রকাশ করেনি, ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা। কিন্তু মানবসভ্যতার ইতিহাস কী বলে। বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অনেক পরে রুয়ান্ডা, বসনিয়া ও কম্বোডিয়ায় সংঘটিত গণহত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালত বিচার করেছেন, অপরাধীদের শাস্তি হয়েছে। ওই সব দেশে গণহত্যাকারীরা দুঃখ প্রকাশ করেছে, ক্ষমা চেয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাজি বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছে তার বিচার যুদ্ধের পরপরই হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানি একাধিকবার রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। ‘অ্যান ইরা অব ডার্কনেস’ গ্রন্থের ভূমিকায় শশী থারুর উল্লেখ করেছেন, ১৯৭০ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ড পোল্যান্ড সফরের সময় সেখানকার ঘেটো, যেখানে কয়েক লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয় তার পাদদেশে হাঁটু গেড়ে জনসমক্ষে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। সুতরাং ইতিহাসের পথ ধরেই একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের বিচার বাংলাদেশের মানুষ চায়। যারা অপরাধ করেছে তারা বেঁচে না থাকলেও রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, প্রতীকী বিচার হবে এবং পাকিস্তানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যান্য যে দাবিই করি না কেন, তার সঙ্গে সব জায়গা থেকে, সব পন্থায় এ বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষকে উচ্চকণ্ঠ থাকতে হবে। এটা আমাদের জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন, এখানে কোনো আপস হতে পারে না।

২৫ মার্চ উপলক্ষে গণমাধ্যমে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে এবং বিভিন্ন সংগঠন অনেক আলোচনাসভাও করেছে। সব জায়গায় মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে এসেছে, আমরা এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই। এই দাবি যথার্থ, ঠিকই আছে। কিন্তু পাকিস্তানের বিচারের দাবি, ক্ষমা চাওয়ার কথা কোথাও নেই, সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ কারণেই মনে হয়েছে, এটা যেন ছদ্মবেশী অদৃশ্য কোনো ব্যক্তি, পক্ষ বা জায়গা থেকে আমাদের মুখে তুলে দেওয়া হয়েছে এই কথাটি যে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই। এই দাবির সঙ্গে যদি পাকিস্তানের বিচার ও ক্ষমা চাওয়ার দাবিটি সমান গুরুত্বের সঙ্গে আসত, তাহলে কারো মনে সন্দেহের উদ্রেক হতো না। তবে এ ব্যাপারে আমার ষড়যন্ত্রের ধারণা ভুলও হতে পারে। হয়তো আমরা হুজুগে বাঙালি কোনো কিছু না ভেবেই কোনো একজনের উত্থাপিত প্রতিপাদ্যটির সঙ্গে আমরা সবাই গড্ডলিকা প্রবাহের মতো গা ভাসিয়ে দিয়েছি। আমাদের ভুললে চলবে না যে বাংলাদেশের বড় এক রাজনৈতিক পক্ষ বিএনপি ও তার মিত্ররাসহ ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালন করে না। তারা সব কিছুতে পাকিস্তানি কথার প্রতিধ্বনি করে। শুধু বিচার ও ক্ষমা চাওয়া নয়, একাত্তরে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের যে সম্পদ ছিল, তার সঠিক হিস্যা আমাদের ন্যায্য পাওনা। একই সঙ্গে একাত্তরে বাংলাদেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার ক্ষতিপূরণও দিতে হবে। এসব দাবি নতুন কিছু নয়, বিশ্বের ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। সামনে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন। ভেতর থেকে আরো অনেক বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা হবে। সবারই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

sikder52@gmail.com

শেয়ার করুন