রূপক অর্থে ভোরের আলো মানুষের জীবনে নতুন স্বপ্ন ও সম্ভাবনার বারতা নিয়ে এলেও গত ৪ এপ্রিল ২০২৩-এর সকালটি ‘বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের’ ঘটনার মধ্য দিয়ে হাজার হাজার ব্যবসায়ী, কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের স্বপ্নভঙ্গের খবর বয়ে আনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক হওয়ার সূত্রে সারা দিন চাপা উত্তেজনা বিরাজ করতে দেখেছি আমার সব ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকের মধ্যেও।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটির পূর্ণ কোনো অনুসন্ধান ও গবেষণা এখনো হয়নি, ডেস্ক রিভিউ ও মিডিয়া রিপোর্টিংয়ের তথ্য ধরেই বিষয়টি বিশ্লেষণ করছি। সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানরূপে প্রতিষ্ঠিত, যার মূলকথা হলো একটি চক্রের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস করা। চক্রটি পূর্বপ্রস্তুতি পর্ব, সাড়াদান পর্ব এবং পুনর্গঠন পর্বের সমন্বয়ে গঠিত। সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজারের নিকটস্থ আলাউদ্দিন রোডে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের হেডকোয়ার্টারে অগ্নিকাণ্ডের খবর পৌঁছে। প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর অগ্নিকাণ্ড প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আসে, কিন্তু ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যায় সম্মিলিতভাবে বঙ্গবাজার নামে পরিচিত বিভিন্ন মার্কেট, যেমন—বঙ্গবাজার, সুপ্রীয়া মার্কেট, আদর্শ মার্কেট, মহানগর কমপ্লেক্স, ইসলামিয়া মার্কেট এবং নিকটস্থ এনেক্স টাওয়ারে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার কাপড়ের দোকান।
অগ্নিদুর্ঘটনার জন্য তিনটি জিনিস প্রয়োজন, যথা তাপের কোনো উৎস, যেমন—শর্ট সার্কিট ও ফুয়েল বা তেল বা দাহ্য পদার্থ যেমন—এখানে কাঠ ও কাপড় খুব ভালো দাহ্য পদার্থ এবং অক্সিজেন বা বাতাস, যা আগুনকে নিভতে দেয় না বা জ্বালিয়ে রাখে। এই অনুকূল পরিবেশ পাওয়ায় ভস্ম হয়ে যায় কাঠ ও টিনের কাঠামোতে নির্মিত বঙ্গবাজারের মূল ঘরটি, যেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলে মনে করা হচ্ছে। রোজার ঈদকে সামনে রেখে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কাপড়ের মজুদ করা হয় মার্কেটে।
পূর্বপ্রস্তুতি পর্বে আসে বঙ্গবাজারে কাপড়ের মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা ঝুঁকি নিরসনের ব্যবস্থাপত্রের বিষয়টি। নিশ্চিতভাবে এই ভবনটি অবকাঠামো ভূমিকম্প ও অগ্নিঝুঁকিতে ছিল। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডিজি মহোদয় বলেছেন, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল নোটিশ ও ব্যানার টাঙিয়ে মার্কেট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা হয় এবং পর পর ১০টি চিঠি প্রেরণের কথা তিনি উল্লেখ করেন। পরিশেষে হাইকোর্টে রিট করে বঙ্গবাজার মার্কেট সমিতি অনুমতি সাপেক্ষে ব্যবসা করছিল। প্রস্তুতিতে গাফিলতি পরিলক্ষিত হয় ব্যক্তি পর্যায়ে এবং কমিউনিটি পর্যায়ে। যেসব ব্যবসায়ী কোটি টাকা ব্যবসায় খাটাচ্ছেন তাঁরা সচেতন ছিলেন না অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি কত ভয়াবহ হতে পারে সে বিষয়ে। যদি সচেতন থাকতেন এ বিষয়ে তাঁরা ব্যবস্থা নিতেন। এখানে ‘ফায়ার সেফটি প্ল্যান’ থাকা জরুরি ছিল, যেখানে অগ্নিঝুঁকি নিরূপণ, ফায়ার অ্যালার্ম, জরুরি নির্গমনব্যবস্থা, অগ্নিমহড়া ইত্যাদি নিশ্চিত করা যেত।
রেগুলেটরি বডি ও তদারকিতে সেসব সংস্থা দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতি পর্বে কাজ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা এ দায় এড়াতে পারে না। এবার সাড়াদান বা রেসপন্স বিষয়টি দেখা যাক। ফায়ার সার্ভিসের দল মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে কাজ শুরু করলেও সকাল ৬টা ১০ মিনিট থেকে ৮টা পর্যন্ত খুব বেশি ইউনিট কাজ করতে পারেনি। আগুন নিয়ন্ত্রণে ৫০টির বেশি ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট কাজ করে পূর্ণ শক্তিতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ছয় ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। একাডেমিক ভাষায় ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম যথাযথভাবে কাজ করতে পারেনি। ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা এখানে অকল্পনীয়। এ ছাড়া পর্যাপ্ত পানির উৎস পুরান ঢাকায় পাওয়া দুষ্কর। এটি অবধারিতভাবে অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রমকে ব্যাহত করে। ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব রিজার্ভার ছাড়াও পানির উৎস ছিল হাতিরঝিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর। এমনকি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জলসবুজ প্রকল্প ওসমানী উদ্যানে জলাশয় নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিলেও বাস্তবে সেখানে কোনো জলাশয়ে পানি পাওয়া যায়নি। উত্সুক জনতা নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ, যা সাড়াদান কার্যক্রমে বাধা হয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, আনসার বাহিনীর এবং সর্বোপরি ফায়ার সার্ভিসের দুই হাজার কর্মী এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম অর্থাৎ সক্ষমতা ছিল বলে এই দুর্যোগ সামাল দেওয়া গেছে।
ভোরে দুর্ঘটনা ঘটায় মানুষ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এবং রাস্তায় ভিড় না থাকায় ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন ইউনিটের গাড়ি ঘটনাস্থলে আসতে পেরেছে, নয়তো সাড়াদান কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হতো এবং মৃত্যুর মিছিল বাড়ত। সবচেয়ে দুঃখজনক, মার্কেটের ভেতরে এমনভাবে কাপড় স্তূপ করা হয়েছিল, যা থেকে মানুষ বের হতে পারত না, পাশে বার্ন ইউনিট ও ঢাকা মেডিক্যাল থাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকি কমেছে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্য ও ভলান্টিয়াররা সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন।
সব শেষে পুনর্গঠন বা রিকনস্ট্রাকশন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অন্যতম বড় সংগঠন বঙ্গবাজার পাইকারি কাপড়ের ব্যবসায়ীদের অনেকে মিডিয়ায় বলেছেন, একেকজন ব্যবসায়ীর ১০-২০ লাখ থেকে চার-পাঁচ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এখানে বীমা ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল। বীমা কিংবা ব্যাংক লোনের শর্তাবলির মধ্যেও অগ্নিকাণ্ড প্রস্তুতির কিছু শর্ত পূরণ হতে পারত।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্কে ‘Build Back Better’ বলে একটি কথা রয়েছে। এর অর্থ পরবর্তী সময়ে আমরা যে অবকাঠামো গড়ে তুলব তা অবশ্যই দুর্যোগ সহনশীল হতে হবে। কাঠামোগত এবং অকাঠামোগত (আইনের প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি) এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে যেন বঙ্গবাজারকে পুনর্নির্মাণ করা হয়। শুধু মৃত্যু হ্রাস নয়, দুর্যোগের আর্থিক ক্ষতি কমানোও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অন্যতম লক্ষ্য। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ২০২১-২০২৫-এর প্রধান কার্যক্রম ও লক্ষ্যমাত্রায় নগর দুর্যোগ, যেমন—ভূমিকম্প ও আগুনের মতো দুর্যোগের সক্ষমতা বৃদ্ধির বেশ কিছু প্রকল্প রয়েছে। দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি (Sod-2019)-এ সুরক্ষা সেবা বিভাগ, রাজউক, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব বিষয়ে বলা আছে। পরিশেষে অগ্নিবিষয়ক গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও পরিচালক ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়