ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ও সেন্টার ফের জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ রচিত একটি বইয়ের তথ্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বইয়ের তথ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনগুলো তাঁর বিচার দাবি করেছে।
অভিযোগ আছে, অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ২০০৯ সালে পাকিস্তানের একটি ইনস্টিটিউটের আর্থিক সহযোগিতায় ‘হিস্টোরাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভার্সেস পারসন’ নামে একটি বই লেখেন। বইটি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি এ বইয়ের ওপরে একটি নিবন্ধ লেখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এর পরই বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।
বইটিতে বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ আনা হয়। পুরো বইটিতে জাতির পিতার নামের আগে কোথাও ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি একবারের জন্যও ব্যবহার না করায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থকরা।
মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলেন, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে চরমভাবে অবমাননা করে দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ। আমরা তাঁর এমন দুঃসাহসিক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ লেখনীর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। জাতির পিতাকে অবমাননা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করার অপরাধে তাঁকে অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারণ করতে হবে এবং এই বই বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করতে হবে। এই বইয়ের প্রকাশক ইউপিএলকেও এর দায়ভার নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা শব্দগুলোকে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ খর্ব করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত একটি এজেন্ডায় সিন্ডিকেট ডেকে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।
‘হিস্টোরাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড : স্টেট ভার্সেস পারসন’ বইয়ের ৪০ পৃষ্ঠায় অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য তিনি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে হাজির হন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে বক্তব্যের শেষে ‘জয় পাকিস্তান’ বলতে শুনেছেন। বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি চরম অবমাননা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবং শহীদদের সংখ্যাটি বাস্তবতার চাইতে আবেগগত তাড়নায় নেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।
বইয়ের ৪১ পৃষ্ঠায় একাত্তরে পাকিস্তানিদের দ্বারা পরিচালিত পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম এই নিধনযজ্ঞকে তিনি গণহত্যা বলে অভিহিত করলেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এই গণহত্যাকে ‘গণহত্যা’ বলা যায় কি না তা নিয়ে তর্ক উত্থাপন ও একাত্তরে অন্তত ১৫ থেকে ৫০ হাজার বিহারিকে বাঙালিরা হত্যা করেছে বলে একটি বিদেশি প্রকাশনা উল্লেখ করে তার তদন্ত দাবি করেছেন।
বইয়ের ২০ পৃষ্ঠায় জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা করা ছাড়া শুধু সরকারি নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধকালের জাতীয় পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ দেওয়া ও একাত্তরের গণহত্যা আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বিদেশি শক্তিগুলোর চাইতেও দেশীয় সরকারগুলো বেশি দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন।
জানতে চাইলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা সেন্টার গঠনের জন্য বইটি লেখা হয়েছে ১৪ বছর আগে। পাকিস্তানের সাবটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট পলিসি ইনস্টিটিউট আমাকে জানাল গণহত্যা বিষয়ে একটি বই লিখতে। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী দেখে আমি বইটি লিখলাম।
তিনি বলেন, ওই ইনস্টিটিউটই এ বই প্রকাশের অর্থায়ন করেছে। তবে ইউপিএলকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। বইটির মোড়ক উন্মোচনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য হারুন অর রশিদসহ অনেকেই ছিলেন। তারা ওই সময়ে বইটি পড়েছেন; কিন্তু এত বছর পর কেন বিষয়টি আলোচনায় আসছে সেটি বুঝতেছি না।