দেশের একুশতম রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পর কে হচ্ছেন তাঁর স্থলাভিষিক্ত? এই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হয়েছে গত কয়েকমাস। দীর্ঘ জল্পনা-কল্পনায় তাঁর নাম আসেনি একবারও। সংবাদ মাধ্যমের অনুসন্ধানও খুঁজে পায়নি তাঁকে। তিনি নিজেও জানতেন না এমন একটি মহান দায়িত্ব অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, রোববার সকালে সবাই জানতে পারলেন দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। সেদিনই ছিল নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমার শেষ সময়। অবশ্য তিনি নিজে জানতে পেরেছিলেন ৯ ফেব্রুয়ারি। কৌশলগত কারণে তিনিও এই তথ্য প্রকাশ করেননি।
কেমন হয়েছে চমক দেখানো নতুন রাষ্ট্রপতি, এই প্রশ্ন ছিল সাধারণ মানুষের মনে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্পর্কে বলেন, ‘নতুন রাষ্ট্রপতির একটি গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে। তিনি প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন পোড় খাওয়া মানুষ, বীর মুক্তিযোদ্ধা। পঁচাত্তর পরবর্তী সময় তাঁকে গ্রেফতার করে ডান্ডাবেড়ি দিয়ে রাখা হয়েছিল, কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী। তিনি জুডিসিয়াল সার্ভিসেও চাকরি করেছেন। বিএনপির আমলে বাধ্য হয়ে তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে। তাঁর মাঝে দায়িত্ববোধ, রাজনৈতিক সচেতনতা, দেশপ্রেম রয়েছে। প্রচার বিমুখতার কারণে তিনি হয়ত সেভাবে সামনে আসেননি।’
প্রধানমন্ত্রী এভাবেই মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগের যৌক্তিকতা তুলে ধরে সাধারণ মানুষের কৌতূহল মিটিয়েছেন। এই সময় কাকে রাষ্ট্রপতি করা হলে শক্ত হাতে হাল ধরতে পারবেন সেই বিবেচনায় ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আওয়ামী লীগও এই সত্য বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি নিয়োগে শেখ হাসিনাকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে রেখেছিল। দীর্ঘ সময় ধরে দেখে-শুনে-বুঝেই তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে প্রধানমন্ত্রী পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন দীর্ঘ সময় ধরে। বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় কমিশন প্রধান হিসেবে তাঁর সাহসী পদক্ষেপ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরে তাঁকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার পদে নিয়োগ দেন। দুই মেয়াদ দায়িত্ব পালনকালেও তিনি সাহসিকতা, সততা এবং কর্মনিষ্ঠার পরিচয় দেন। কর্মজীবন শেষে তিনি আবারও রাজনীতিতে ফিরে আসেন এবং পাবনার একটি আসন থেকে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। প্রায়ই তাঁর পুরনো রাজনীতির চারণভূমি পাবনা সফর করতেন এবং এলাকার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। শেখ হাসিনা তাঁকে আওয়ামী লীগের নির্বাচন সম্পর্কিত কমিটির সদস্য নিয়োগ করেন। এই কমিটি দলীয় অংশগ্রহণে সকল নির্বাচনের আইনগত দিক পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনে দেন-দরবার করে থাকে।
১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর পাবনা জেলার সদর থানার জুবলীট্যাঙ্ক পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। ছাত্রজীবনেই জড়িত হয়ে পড়েন রাজনীতির সঙ্গে। ’৬৭-৬৮ সালে ছিলেন অ্যাডওয়ার্ড কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ’৭০-৭৩ পর্যন্ত ছিলেন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। ’৭১ সালের শুরুতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পাবনা জেলা কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। পরে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে তিনি সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন মুক্তিযুদ্ধে।
সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেন মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪-৭৫ সালে তিনি যুবলীগের জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করা হলে তাঁকে পাবনা জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। একই বছর তিনি পাবনা আমিনউদ্দিন আইন কলেজ থেকে আইন পাস করেন। সেই বছর কলেজ থেকে ১০৩ জন পরীক্ষা দিলেও একমাত্র তিনিই পাস করতে সক্ষম হন এবং দ্বিতীয় বিভাগ লাভ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তিনি পাবনায় প্রতিবাদ শুরু করেন। গড়ে তোলেন প্রতিরোধ আন্দোলন। ২০ আগস্ট তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং তিন মাস অবিরাম নির্যাতন চলে তাঁর ওপর। তিন বছর কারাভোগ করে ’৭৮ সালে অনেকটা পঙ্গু অবস্থায় তিনি মুক্তিলাভ করেন। ’৭৮ সালে তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেন এবং বিচারকের বিভিন্ন পদে চাকরি করেন।
১৯৯৫ সালে তিনি বিচারকদের সরাসরি ভোটে জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন। তখন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারক গোলাম রসুল। মহাসচিব হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর বিচার কাজে তাঁর সভাপতিকে সহায়তা করেন। আপিল বিভাগে মামলার শুনানির সময় তাঁকে আইন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নানা নিগ্রহে তিনি চাকরির মেয়াদ ১২ বছর বাকি থাকতেই ২০০৬ সালে জেলা ও দায়রা জজ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়। হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনসহ নির্মম নির্যাতন চলে প্রায় দুই বছর ধরে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ওইসব ঘটনার তদন্তে ২০০৯ সালে ‘বিচার বিভাগীয় কমিশন’ গঠন করা হয়। এই কমিশনের প্রধান ছিলেন সাহাবুদ্দিন। সারাদেশ ঘুরে নির্যাতিত ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি থেকে তুলে আনেন নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র।
তাঁর ভাষায় ‘এটি ’৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের চেয়ে কোনোভাবেই কম ছিল না।’ তখন সারাদেশে প্রায় ১৬ হাজার নির্যাতনকারীকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।
তিনি ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুদকের কমিশনার নিযুক্ত ছিলেন। তখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের একটি টিমও দুদকের সঙ্গে কাজ শুরু করে। বিশ্বব্যাংক মামলাটি তাদের মতো করে সাজানোর চেষ্টা করলে দুদক তাতে রাজি হয়নি।
দুদকের কমিশনার মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন সাহসের সঙ্গে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের কাজ করে যান। ক্ষিপ্ত বিশ্বব্যাংক দল তখন তাঁর বিরুদ্ধে অর্থমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে নালিশও করেছিল। দুদক সাহসের সঙ্গে প্রকৃত ঘটনা উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বিশ্ব্যাংকের সকল অভিযোগ নাকচ করা হয়। তখন বিষয়টি রাজনৈতিক উল্লেখ করে অনেকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও দেড় বছর পর কানাডার আদালত একই রায় প্রাদান করে। দুদকের রিপোর্টের সঙ্গে এই রায়ের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। আদালত বলেছে, ‘বহুল আলোচিত এই অভিযোগের কোনো সারবস্তু নেই।’
গত ১২ ফেব্রুয়ারি আর কোনো মনোনয়নপত্র জমা না পড়ায় নির্বাচন কমিশন তাঁকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। আজ ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যভার গ্রহণ করলেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন । মত ও পথ পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা তাঁকে স্বাগত জানাই। অভিনন্দন মহামান্য রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতির পদটি জাতির প্রধান পদ। সাংবিধানিকভাবে দায়িত্ব বর্তায়। তাছাড়া বাংলাদেশে এখন সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত আছে,আমরা আশা করি, তা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। সুতরাং আগামী নির্বাচন যাতে সাংবিধানিকভাবে সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হয়, সেটি উনি দেখবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি। ইতোমধ্যে তিনি বলেছেন, বঙ্গভবন ও রাষ্ট্রপতি পদের পদমর্যাদা রক্ষা করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে হয়, তিনি সে ব্যবস্থা করবেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে স্বপ্ন ছিল, ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ; আমরা আশা করি, তাঁর কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমানে যে ভিশন স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, তাতেও বর্তমান রাষ্ট্রপতির ইতিবাচক ভূমিকা থাকবে।