আজ মহান মে দিবস। মে দিবস পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি ও অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার প্রকাশের দিন। শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে প্রেরণাদানকারী এই দিনটি সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে মে দিবস পালন করছেন মেহনতি শ্রমজীবী মানুষ, যার সূচনা হয়েছিল ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে। শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিকদের রক্তপাতের মাধ্যমে যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণি মে দিবসকে শোষণ মুক্তির দিশারি হিসেবে গর্ব ও প্রত্যয়ের সঙ্গে পালন করে আসছে। উন্নত দেশগুলোতে শ্রমিকরা তাঁদের অধিকারকে আরো সংহত করার আওয়াজ তোলেন এই দিনে। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই দিবসটি এখনো শ্রমিকদের অস্তিত্ব রক্ষার দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং ৩০ লাখ মানুষের জীবনদানের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। আমরা এরই মধ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পার করেছি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত দেশের শ্রমিক শ্রেণি তথা শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। স্বাধীনতার ৫২ বছরে দেশ রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে। অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়িত হয়েছে। কিন্তু দেশের শ্রমজীবী মানুষ, যারা শুধু উৎপাদনব্যবস্থারই অংশ নয়, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের হাতিয়ার, তারা কতটুকু এর সুফল ভোগ করতে পেরেছে বা পারছে?
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক কোনো ক্ষেত্রেই মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের দেশের শ্রমিক-কর্মচারীরা এখনো বাঁচার মতো মজুরি, আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুযায়ী অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারসহ অন্যান্য ন্যায়সংগত অধিকার, সামাজিক মর্যাদা ও সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। কয়েক বছর ধরে মুক্তবাজার অর্থনীতির দাপট এবং মুনাফাখোর ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কারসাজিতে দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি বর্তমানে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে শ্রমিক-কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ এক অসহায় মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশনসসহ বিভিন্ন কলকারখানার ভবনধস, অগ্নিকাণ্ড ও অন্যান্য দুর্ঘটনায় হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী হতাহত হলেও আমাদের দেশের শ্রমিকদের কর্মস্থলের নিরাপত্তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮৮ শতাংশ অসংগঠিত খাতের শ্রমিক। নির্মাণ, চাতাল, ওয়েল্ডিং, গার্মেন্ট ও বহু শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠানে এখনো ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইপিজেডের জন্য আলাদা শ্রম আইন করা হয়েছে। একটা দেশে দুইটা শ্রম আইন, এটাও নিয়মবহির্ভূত। পার্টিসিপেটরি কমিটির নামে পোশাকশিল্পসহ নতুন নতুন শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব করা হয়েছে। পার্টিসিপেটরি কমিটি কোনোভাবেই ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প হতে পারে না। ট্রেড ইউনিয়ন করতে না পারার কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের এসব শ্রমিক ন্যায্য মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দর-কষাকষিও করতে পারে না। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বেশির ভাগ শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা নেই। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করা হয় না। তাদের ছুটি দেওয়া হয় না। একজন শ্রমিক হিসেবে নারী শ্রমিক শ্রম আইন অনুযায়ী সব অধিকারের সমান অংশীদার হলেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। নারী শ্রমিক অধ্যুষিত গার্মেন্ট ও অন্যান্য ক্ষুদ্র শিল্প ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে স্বল্প মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিম্ন পদমর্যাদা, খণ্ডকালীন নিয়োগ, যখন-তখন ছাঁটাই, অধিক শ্রমঘণ্টা, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র থেকে সাপ্তাহিক ছুটি, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। এ ছাড়া অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সুপেয় পানির অভাব, যৌন হয়রানিসহ অনেক সমস্যার মুখে তাদের পড়তে হয়। সমকাজে সমমজুরি না থাকা এবং নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য তো রয়েছে। কৃষি ও গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও তাঁদের কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। গৃহকর্মে নিয়োজিত নারীরা সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত।
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকা একটা মানুষের মৌলিক ও আইনগত অধিকার। করোনা মহামারি বিশ্বের মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ মানুষের জন্য কতটা প্রয়োজন। অথচ কর্মপরিবেশের দিকে আমরা নজর খুব কমই দিয়ে থাকি। নিরাপদ ও সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। মালিক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর একযোগে কাজ করলে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এমন কঠিন কিছু নয়। একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ প্রদান এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশের অনুশীলন করা প্রত্যেক মালিকের নৈতিক ও আইনগত কর্তব্য। শ্রম আইনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তা বিধান করা। শ্রম আইন ও অন্যান্য বিষয়ে মালিকদেরই সচেতন হতে হবে।
শিল্পে কর্মরত শ্রমিক সুস্থ ও নিরাপদ থাকলে শিল্পে উৎপাদনক্ষমতা বাড়ে। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যয় কোনো খরচ নয় বরং বিনিয়োগ, এই উপলব্ধি বাংলাদেশের শিল্প মালিকদের মধ্যে এখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে শ্রমিকরা এখনো কর্মক্ষেত্রে এবং কর্মক্ষেত্রের বাইরে উভয় অবস্থায়ই বিপদগ্রস্ত। রানা প্লাজা ধসের পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি বিশ্ববাসীর নজরে আসে। পরবর্তী সময়ে শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়ে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি।
আমাদের দেশের শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হলে তাদের যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, তা খুবই অপ্রতুল। দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, আইএলও কনভেনশন ১২১ ধারা অনুযায়ী ‘লস অব ইয়ার, পেইন অ্যান্ড সাফারিং’ ভিত্তিতে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য। কিন্তু সরকার ও মালিকরা এখনো শ্রমিকদের ন্যায়সংগত এসব দাবি আমলে নেয়নি। কর্মস্থলে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণকারী শ্রমিকদের পুনর্বাসনেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ ওই শ্রমিকদের উপার্জন দিয়েই তাঁর পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো হতো। শ্রমিক ও তাঁর পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
যখন কোনো কারখানা গড়ে তোলা হবে, তখন অবশ্যই তার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি কারখানায় যথাযথ অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। জরুরি নির্গমনের পথ থাকতে হবে। যে ভবনে কোনো কারখানা গড়ে তোলা হবে, সেই ভবনটি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী করা হয়েছে কি না তা পরখ করে দেখতে হবে। কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঠিক না থাকলে সাধারণ শ্রমিক ও সেফটি কমিটিকে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে কারখানা অবকাঠামো ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি ও উপকরণের মতো পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ব্যয়কেও প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আমাদের দেশের বার্ষিক গড় আয়ের বড় অংশ আসে শিল্প খাত থেকে। তাই এসব শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য শ্রমঘন এলাকায় শ্রমিকদের নিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ এবং স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর নয় এমন কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করা সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব। এ বিষয়ে যদি সঠিক ও যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে অব্যাহতভাবে উৎপাদন বাড়বে, আয় বাড়বে এবং এগুলো প্রতিষ্ঠিত হলে কাজের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে।
সম্প্রতি সরকার অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা খাতে কথিত বেআইনি ধর্মঘট করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করে জাতীয় সংসদে যে বিল উত্থাপন করেছে, তা কোনোভাবেই সঠিক হয়নি। এটা শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এই প্রস্তাব আইন হিসেবে পাস হলে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকে খর্ব করবে। যেখানে আমাদের দেশে শ্রমিকরা প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী তাদের ন্যায়সংগত অধিকার আদায় করতে গেলে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে মালিকরা তাদের চাকরিচ্যুতিসহ নানাভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন করে থাকে, সেখানে এই ধরনের পদক্ষেপ মালিকদের আরো শ্রমিক নির্যাতনের আইনি বৈধতা দেওয়ার শামিল হবে।
শ্রমিকদের সব ধরনের বৈষম্য থেকে রক্ষা করার এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার শর্ত শুধু শ্রম আইন ও বিধিমালায় থাকলেই চলবে না, তা বাস্তবায়নের জন্য কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পেশাগত অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও নিয়োগকর্তাদের এগিয়ে আসতে হবে এবং এর মাধ্যমে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে। এর মধ্য দিয়ে দেশের শিল্পের বিকাশ এবং টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।