যে ‘সাংবাদিকতা’ সমাজে ‘ধর্ষণকামী’ বাড়ায়

হাসান শান্তনু

গত আশি, নব্বইয়ের দশকে ‘সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে’ প্রখ্যাত সাংবাদিক শফিক রেহমান ‘পলিটিক্সের সঙ্গে সেক্স’, বা ‘সেক্সের সঙ্গে পলিটিক্স’ মিশিয়ে যে ধারার সাংবাদিকতার প্রচলন করেন, তা আজকালের ঢাকা-কলকাতার ‘ডিজিটাল যৌন সাংবাদিকতার’ মতো এতো নিম্নরুচির ছিলো না। কলকাতার ‘সানন্দায়’ কথিত নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া ‘দেবরের’ রগরগে বর্ণনায় পাশের বাড়ির ‘বৌদির’ যে চরিত্র ফুটে উঠতো, সেখানেও সবশেষে একটা ‘পরামর্শমূলক’ বক্তব্য পাওয়া যেতো। কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকার’ আজকালের ‘সাংবাদিকতার’ মতো সেগুলো ‘স্রেফ যৌন উস্কানিদায়ক’ ছিলো না। মূল আলোচনার আগে ভিন্ন প্রসঙ্গে একটু বলা যাক। কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অভিশাপ’ কবিতার বিরুদ্ধে তখন গেরুয়াবাজদের তুলকালাম কাণ্ড চলছে পশ্চিমবঙ্গে।

ভারতে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীন বিজেপির উগ্রগন্ধীরা ‘হিন্দুত্ববাদের অনুভূতিতে আঘাতের’ অভিযোগে শ্রীজাতের মুণ্ডুপাত করছেন। বিজেপির এক নেতার মুসলমান নারীদেরকে কবর থেকে তুলেও ‘ধর্ষণের’ আহবান জানানোর প্রতিবাদে শ্রীজাত ‘অভিশাপ’ কবিতাটি লেখেন। এতে তিনি লেখেন, ‘আমাকে ধর্ষণ করবে যদ্দিন কবর থেকে তুলে/ কনডম পরানো থাকবে তোমার ওই ধর্মের ত্রিশূলে’! বিজেপি নাখোশ হওয়ার ভয়ে পশ্চিমবঙ্গের কবি, লেখকদের মধ্যে অনেকে তখন শ্রীজাতের পক্ষে একটা শব্দও খরচ করেননি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সিপিআইএমের ‘গণশক্তি’সহ দু’য়েকটা পত্রিকা শুধু শ্রীজাতের পক্ষ নেয়। ঢাকার প্রগতিশীল কবি, লেখক, সাংবাদিকরাও তখন শ্রীজাতের পক্ষে, বা অক্ষরের ডানপাশে অক্ষর বসিয়ে কবিতা লেখার স্বাধীনতার জন্যে সম্মিলিত বক্তব্য-বিবৃতি দেননি।

universel cardiac hospital

অথচ বাংলাদেশে মৌলবাদীগোষ্ঠীরা চাপাতির কোপে মুক্তচিন্তার ব্লগার, প্রকাশক হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা পালনকালে শ্রীজাত দৃপ্ত উচ্চারণে এর প্রতিবাদ করেন। কবিতা লেখেন ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’ শিরোনামে। যা পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়। ওই কবিতা নিয়ে কলকাতার ‘শঙ্খমালা’ নামের নাটকের দল মঞ্চায়নও করে। আমার ‘সৎ সাংবাদিকতার একাল-সেকাল’ (আবিষ্কার প্রকাশনী) বইটি লেখার আগে, বা বইয়ে তথ্যের প্রয়োজনে কবি শ্রীজাতের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করি। শ্রীজাতের মতো সাহসী কবির পক্ষে কলকাতার পত্রিকা, টিভি চ্যানেলগুলো কী ভূমিকা রেখেছিলো, এ বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য জানতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ। কারণ, কলকাতা থেকে প্রচারিত, প্রকাশিত সব সংবাদমাধ্যম নিয়মিত আমার পড়া, দেখা হয় না।

চোখে না পড়া কোনো সংবাদমাধ্যম শ্রীজাতের পক্ষ নিয়েছিলো কী না, এ আলাপের রেশ ধরে একপর্যায়ে আসে ঢাকা-কলকাতার মূলধারার কতিপয় প্রচারমাধ্যমের ‘যৌন সাংবাদিকতা’র প্রসঙ্গ। সেদিন পাঠকনন্দিত ওই কবি সম্মত হন, এ ধরনের ‘সাংবাদিকতা’ সমাজে ‘ধর্ষণকামী’ বাড়াচ্ছে। কাজটা বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সবচেয়ে প্রভাবশালী ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ও যে করছে, এর ভুরি ভুরি নজির আছে। এর সবশেষ নমুনা ঢাকার উত্তরে বুশরা আফরিনের ‘চিফ হিট অফিসার’ হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার খবরটির পরিবেশনা। নারীর প্রতি মর্যাদা দেখানোর বোধও হারিয়ে ফেলেছে পত্রিকাটি! ঐতিহ্যবাহী একটি পত্রিকার এমন কাণ্ড শুধু লজ্জাজনকই নয়, নিন্দনীয়ও বটে।

‘ক্লিক’ বাড়াতে সংবাদমাধ্যমগুলো ‘যৌন সাংবাদিকতার’ যে চর্চা করছে, এতে সমাজ আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সমাজকে অসুস্থ করে তোলা কোনোভাবেই প্রকৃত সাংবাদিকতা হতে পারে না। গণমাধ্যম, সাংবাদিকদের দায়িত্বের জায়গাটা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে কারো সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়ানোটা যথারীতি অপরাধ। সাংবাদিকতার নীতিমালাও তা-ই বলে। কলকাতার সোনাগাছির, বা ময়মনসিংহের গাঙ্গিনার পাড়ের যৌনালয়ের দালালি আর সাংবাদিকতা সমান দায়িত্বের নয়। যে কোনো সংবাদকে যৌনপণ্যের মতো উপস্থাপনা যৌনপল্লির দালালরাও করেন না। সাংবাদিকরা তা করবেন কেন?

পরিশেষে বলা যায়, আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে বুশরা আফরিনের ছবি ফটোশপে কারসাজি করে ‘প্রতিবেদন’ করা হয়েছে। পত্রিকাটির ফেসবুক পাতায় ‘প্রতিবেদনটি’ শেয়ারের বেলায় তারা ব্যবহার করেছে শ্রীজাতের লেখা গানের লাইন। মূল গানটি হলো- ‘চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন/ … আহা উত্তাপ কতো সুন্দর/ তুই থার্মোমিটারে মাপলে’। শ্রেয়া ঘোষালের গাওয়া এ গান ‘অটোগ্রাফ’ সিনেমায় সংযোজিত হয়। শ্রোতাপ্রিয় একটা গানের কথার কী অভব্য ব্যবহার আনন্দবাজার পত্রিকার!

হাসান শান্তনু: সাংবাদিক ও গণমাধ্যম গবেষক।

শেয়ার করুন