তাঁর ফিরে আসা মাটি ও মানুষের টানে

আলী হাবিব

জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের একটা বিখ্যাত গানের কথা মনে পড়ছে। এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার/ওকি সূর্য নাকি স্বপনের চিতা/ওকি পাখির কূজন নাকি হাহাকার।/রাত্রি সে তো স্বভাবে মলিন তাকে সয়ে থাকা যায়/ভোরের পথের দিকে চেয়ে থাকা যায়/সে ভোর অন্ধ হলো নিজেই এখন…।

এমন অন্ধকার দিন অনেক এসেছে আমাদের জীবনে। গানের কথার মতোই অন্ধ ছিল ভোর। ঘোর তমসার সময় এসেছিল। একেকটি দিন ছিল রাতের চেয়েও অন্ধকার।

তাঁর ফিরে আসা মাটি ও মানুষের টানে১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দিনের আলো ঢেকে দিয়ে এসেছিল অন্ধকার দিন। সে-ও একসময় ছিল। তখন রাজনীতি ঘরোয়া, রুদ্ধ বাকস্বাধীনতা। অপরাধ স্বপ্ন দেখা। দিশাহীন সময়ের চোরা ঘেরাটোপে তখন পথ হারিয়েছে কত শত সম্ভাবনা। তখন সকাল ছিল ম্লান, বিষণ্ন দুপুর। বিবর্ণ বিকেল গেলে সন্ধ্যা আসত নেমে বেদনার রং মেখে। তখন সবার যেন গণ্ডি বাঁধা ছিল। পায়ে পায়ে জড়ানো ছিল অদৃশ্য শিকল।

১৭ মে ১৯৮১, বৈরী প্রকৃতির এই পিতৃহীন দেশে ফিরে এসেছিলেন তিনি। তখন ‘হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন/জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান,/গত আকালের মৃত্যুকে মুছে/আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।’ স্বজনহীন দেশে তাঁর ফিরে আসা মানেই তো দেশের মাটিতে ফের প্রাণের সঞ্চার। তাঁর ফিরে আসা মানেই তো ম্লান মুখে হাসি। ফসলের মাঠও হাসে প্রাণের সবুজে। না, এখানেই কিন্তু শেষ নয়। তাঁর আগমনে ‘…সারা দেশ দিশাহারা/একবার মরে ভুলে গেছে আজ/মৃত্যুর ভয় তারা।’—এমনই এক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল সেদিন। তাঁর ফিরে আসা মানেই তো নতুন স্বপ্ন দেখা। তাঁর ফিরে আসা মানে ধূসর জীবন ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে ফের বাঁচার তাগিদে। যে তরুণ স্বপ্ন দেখে আসন্ন বিপ্লবে, সে যাবে সবার আগে রাঙাবে জীবন। তিনি সেই তরুণের স্বপ্ন-সারথি। যে কৃষক স্বপ্ন বোনে মাঠের সবুজে, তিনি তাঁর ফসলের সোনাঝরা হাসি।

এরপর অনেক বন্ধুর পথ হাঁটতে হয়েছে তাঁকে। নিতে হয়েছে জীবনের ঝুঁকি। কিন্তু জনকল্যাণের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছেন যখন, তখন জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। পায়ে পায়ে পাথর সরিয়ে সেই পথপরিক্রমায় ২০০৬ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটে যায় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ওয়ান-ইলেভেনের সরকার নামে এক অদ্ভুত শাসনব্যবস্থা চেপে বসে বাংলাদেশে। সেই ‘চেপে বসা’ সরকার বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। তাদের প্রধান লক্ষ্য হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

২০০৭ সালের ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অসুস্থ পুত্রবধূ ও কন্যাকে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রে যান। ৫ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে ভোটার আইডি কার্ড করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন অনুষ্ঠান দেড় বছরের আগে হবে না। এমন ঘোষণায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পথে পা বাড়ান শেখ হাসিনা। ৭ এপ্রিল তিনি এক সাক্ষাৎকারে বিবিসি রেডিওকে বলেন, দীর্ঘদিন জরুরি অবস্থা দিয়ে দেশ চালানোর ফল শুভ হয় না। তিনি প্রশ্ন করেন, নির্বাচন করতে দেড় বছর লাগবে কেন? এর ঠিক দুদিন পর ৯ এপ্রিল তেজগাঁও থানায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় তিন কোটি টাকা চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা। শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলার কোনো সত্যতা নেই। দেশে ফিরে তিনি মামলা মোকাবেলা করবেন। তিনি দেশে ফিরে আসার ঘোষণা দেন। ১৩ এপ্রিল শেখ হাসিনা ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, তাঁকে দেশে ফিরতে দেওয়া না হলে তাঁর লাশ ফিরবে। তিনি লন্ডন হয়ে ২৩ এপ্রিল দেশে ফেরার সিদ্ধান্তের কথা জানান। ১৮ এপ্রিল সরকার প্রেস নোট জারি করে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। সব এয়ারলাইনসকে জানিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে বহন না করার জন্য। এরই মধ্যে ১৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকন্যা লন্ডন পৌঁছেন। তিনি এ সময় লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন এবং মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিতে থাকেন। ২৩ এপ্রিল ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন অনড়। কিন্তু ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করে ঢাকার উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ করতে হিথরো বিমানবন্দরে গেলে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ তাঁকে ঢাকা ফ্লাইটে নিতে রাজি হয়নি। ২৫ এপ্রিল সরকার শেখ হাসিনার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ৫২ দিন পর ২০০৭ সালের ৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। বিমানবন্দরে বিপুলসংখ্যক মানুষ তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানায়। আজ সেই ৭ মে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। সংকটের আবর্তে ডুবে থাকা দেশকে পুনরুদ্ধার করে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তোলার সংগ্রামে ব্রতী হন তিনি। তাঁর সফল নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয়।

সরকারের শুরুতেই ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের মতো একটি ঘটনা সামাল দিতে গিয়ে অনেক বেগ পেতে হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তা প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় বিএনপি জোট। বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা শুরু করেন। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্পন্ন করে আবারও ক্ষমতায় যাওয়া এবং সরকার পরিচালনা করতে পারা অনেক দুরূহ কাজ ছিল। সেখানেও সফল হয় সরকার।

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের দেশ পরিচালনায় কী পেল বাংলাদেশ? এই সময়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশ এখন শতভাগ বিদ্যুতের দেশ। সড়ক যোগাযোগব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে দেখিয়েছে নতুন স্বপ্ন। ঢাকায় চলছে মেট্রো রেল।

২০০৯ থেকে ২০২৩—এই ১৫ বছরে অভূতপূর্ব আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে একটি উন্নয়নের রোল মডেল। কভিড পরিস্থিতি মোকাবেলার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দা মোকাবেলায়ও দক্ষতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এই অর্জনের পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সরকার।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, বাংলাদেশ তার নিরপেক্ষতার নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একটি মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছে বলে এখন বেশ স্পষ্ট। তিনিও মনে করেন, বাংলাদেশ এখন একটি অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্প। মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, বাইডেন প্রশাসন প্রকাশ্যে ও আড়ালে জোর দিয়ে বলছে, তাদের কাছে বিশেষ পছন্দের কেউ নেই। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ নেই। গত শুক্রবার বিকেলে লন্ডনে এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছেন, তিনি তাঁদের জন্য বিশাল বড় অনুপ্রেরণা। একজন শেখ হাসিনার সাফল্য এখানেই। দেশের মধ্যে তো বটেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাঁর নেতৃত্ব আজ স্বীকৃত।

এই সময়ে একজন শেখ হাসিনাকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। দল ও সরকারের নেতৃত্বে একজন শেখ হাসিনা আছেন বলেই আমরা আশাবাদী হই। তিনি এ দেশের মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারেন। এই মাটিকে খুব ভালো করে চেনেন তিনি। ২০০৭ সালের ৭ মে ‘চেপে বসা’ শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ফিরে এসেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ সত্যিকার অর্থেই ‘বিশ্বের বিস্ময়’।

লেখক : সাংবাদিক ও ছড়াকার

habib.alihabib@gmail.com

শেয়ার করুন