বাংলাদেশের আর্থিক খাত যে খুব ভালো অবস্থানে আছে, তা নয়। এখানে কিছু ব্যাংকের সমস্যা আছে। লিজিং কম্পানি, যেগুলো অতটা নামি না, সেগুলোর অবস্থাও খুব ভালো না। নামিদামি কয়েকটি মোটামুটি ভালো করছে। এগুলো গভীরভাবে দেখার বিষয়। আমাদের সামনের ছয় মাস বা এক বছর কিন্তু একটু জটিল। ডলার সংকটের কারণে আমদানি করা যাচ্ছে না। বহুজাতিক অনেক কম্পানি তাদের লভ্যাংশ এবং পুঁজি বাইরে পাঠাতে পারছে না। খবরে দেখা যাচ্ছে, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান তাদের প্যারেন্ট কম্পানি থেকে ফরেন এক্সচেঞ্জে লোন করছে। কেন করছে? কারণ তারা ফরেন এক্সচেঞ্জে কিছু আনতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার দিচ্ছে না। এর ফল হচ্ছে, ফরেন এক্সচেঞ্জের লোন করে সেটি তারা ব্যবহার করছে। এটি কয়টি কম্পানি করতে পারবে?
এখন একমাত্র উপায় আছে, আমাদের যদি এক্সপোর্ট গ্রো করে এবং রেমিট্যান্স যদি আরো বাড়ে এবং ব্যালান্সে চলতি হিসাবে যে ঘাটতি সেটি যদি উন্নত হয়, তাহলে এখন আমাদের যে প্রবৃদ্ধি, যেটি বলছে যে সাড়ে ৫ শতাংশ সেটিও মন্দ নয়, যদি আমরা অর্জন করতে পারি।
মূল্যস্ফীতি আমাদের সামনে একটি বড় বাধা। মূল্যস্ফীতি দুটি কারণে হতে পারে। আমদানি খরচ যদি বাড়ে, তাহলে মূল্যস্ফীতি হবে। তা ছাড়া তেলের দাম, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। এর মাধ্যমে কিন্তু এক ধরনের মূল্যস্ফীতি হতেই থাকবে। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্রদের।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার পরিচয় দিতে হবেবাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা ভালো নয়। বাংলাদেশে তো আমরা অনেক ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছি। এর মধ্যে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর বিষয়ে আমরা খুব শঙ্কিত। তারা কিন্তু সহজে জনগণের কাছ থেকে ডিপোজিট পাচ্ছে না। মানুষের তো তাদের বিশ্বাস করতে হবে। মানুষ তো বিশ্বাস করে না তাদের। না করারও কারণ আছে। মাঝেমধ্যে এমন সব খবর যখন বের হয় যে কেউ কেউ ওই ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। ঋণখেলাপি হয়েছে। দেশ থেকে ঋণ নিয়ে কেউ ভেগে গেছে। তখন তো ওই সব ব্যাংকের ওপর থেকে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। তখন আমানতকারীরা তাদের ডিপোজিট তুলে নিতে শুরু করে। নতুন করে ডিপোজিট করতে আস্থা পায় না।
এই যে কিছু বিশেষায়িত ব্যাংকে গত ছয় মাসে তারল্য সংকটে ভোগার কাহিনি ঘটেছে। এর পেছনে তো কাহিনি এটিই ছিল। মানুষ তাদের ডিপোজিট উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। নতুন করে কেউ ডিপোজিট করছিল না। তখন তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে তাদের অবস্থা অবহিত করে। তারল্য সংকটে ভোগার বিষয়টি তুলে ধরে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সাহায্য চেয়ে ধরনা দিয়েছে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক যতটা পেরেছে তাদের ক্রেডিট দিয়েছে। ঋণ দিয়েছে স্বল্প সুদে। এগুলো ঘটছে কেন? ওই ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থার ঘাটতির কারণে। এখন অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসন আগের চেয়ে কিছুটা কড়াকড়ি করছে। সময় থাকতে প্রশাসনকে কড়াকড়ি করতে হবে।
আরো কিছু ব্যাংকের রোগ এখনো যায়নি। এখনো কিছু ব্যাংক মানুষের টাকা দিতে পারছে না, যদিও সরকারি কিছু ব্যাংক নতুন করে অর্থায়ন করেছে। এই পরিস্থিতিতে এখনো কিছু ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারছে না। তাই আমার মনে হয়, জোর করে কোনো প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেও তা কিন্তু সম্ভব নয়। কারণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাঁচে তো মানুষের বিশ্বাসের মাধ্যমে। এখন সরকারি ব্যাংক, যেমন—সোনালী, অগ্রণী, জনতা—এরা পুঁজি দিল, ঠিক আছে। কিন্তু মানুষকে তো ডিপোজিট রাখতে হবে। পুরনো ডিপোজিটররা যেখানে অর্থ পাচ্ছে না, সেখানে নতুন ডিপোজিটর যাবে কেন!
বাংলাদেশের আরেকটি বিষয় বলা ভালো, আমাদের আর্থিক খাতের আরেকটি বিষয় হলো Non-bank financial institution (NBFI) কম্পানি। এগুলোর অবস্থাও কিন্তু বর্তমানে ভালো নেই। চার-পাঁঁচটি বাদে অন্যগুলো তাদের ব্যবসা করতে পারে বলে আমার মনে হয় না। কারণ এগুলোকে বেশি সুদে টাকা নিতে হয়। এখন বেশি সুদে টাকা নিয়ে বেশি সুদে তো এটি ধার দিতে হয়। এই পরিস্থিতিতে তো কাস্টমার থাকবে না। একই ব্যবসা তো ব্যাংকও করছে কম সুদে। এই পরিস্থিতিতে Non-bank financial institution (NBFI)-গুলো তো টিকবে না। টিকতে পারছেও না।
আর্থিক ক্ষেত্রের আরেকটি সেগমেন্ট হচ্ছে পুঁজিবাজার। এখন পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইসের কারণে এটি মন্দা হয়ে গেছে। এর টার্নওভার ৪০০ কোটির নিচে নেমে গেছে। প্রতিদিনে বেচাকেনার এই টার্নওভার এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার কোটি টাকা হতে পারত। আমাদের যে এক্সপোর্ট আছে সে অনুযায়ী এটিই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের ৮০ শতাংশ কম্পানির ট্রেডিং হয় না, তারা ফ্লোরে গিয়ে বসে আছে। এখন ফ্লোর প্রাইসটি পুঁজিবাজারে বেঁচে থাকার জন্য হয়ে গেছে ক্ষতিকর একটি সিদ্ধান্তের মতো। সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন বুঝে দিক বা না বুঝে দিক, এটি কিন্তু প্রায় ৯ মাস চলে গেছে, এখনো ওঠানোর কোনো নাম নেই। এখন এই নির্বাচনী বছরে এটি ওঠাবে কি না, সেটি তো বোঝা যাচ্ছে না। না ওঠানোর সম্ভাবনাই বেশি। মূল ক্ষতিটা হয়ে গেছে ওখানে। এখন ভালো কম্পানিগুলো লিস্টিংয়ে আসছে না। আর ফ্লোর প্রাইসের কারণে বেচাকেনাও কমে গেছে। বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী হতাশ হয়ে এখন ঘরে ফিরে গেছেন।
বলা যায়, ফ্লোর প্রাইসের কারণে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের একটি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। ব্রোকার হাউসগুলো তাদের শাখা বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ তাদের এই পরিস্থিতিতে পোষাচ্ছে না। ১০০ কোটিতে তাদের পোষাবে না। পোষাবে এক হাজার বা এক হাজার ২০০ কোটিতে, যেটি হতে পারত। মুসিবতে পড়লে বা প্রয়োজন হলেও লোকজন শেয়ার বিক্রি করে টাকা নিতে পারছে না। কারণ হচ্ছে ফ্লোর প্রাইসে বিক্রি করা যায় না। আর নিচের দিকেও অ্যালাও হয় না। করলে হয়তো তারা কিছু কাস্টমার পেত। সেটিও হচ্ছে না ফ্লোর প্রাইসের কারণে।
এই অবস্থায় আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আরো দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। অতিরিক্ত ব্যয় কমিয়ে ফেলতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় সরকারি খরচ থেকে সরকারকে দূরে থাকতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, সরকার একটি খাতে খরচ কমিয়ে অন্য খাতে অনেক বাড়িয়ে দেয়। আমাদের কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। কৃচ্ছ্রসাধনকে যদি সরকার শক্তভাবে না ধরতে পারে, তাহলে আমাদের দুঃখ আরো বাড়বে। বাজেটে এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
অনুলিখন : রায়হান রাশেদ