বর্তমান বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে আসছে অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে যথাযথ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। বিশ্বজুুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অপ্রত্যাশিতভাবে হলেও বহিঃস্থ উৎস থেকে কিছু প্রভাব আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়েছে। তাই আসন্ন বাজেটকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করার সুযোগ তেমন নেই। আবার অর্থনৈতিক বাস্তবতাকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। এবারের বাজেটকেও তাই হতে হবে জাতীয় দর্পণ, যেখানে আমাদের সার্বিক রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দর্শনের প্রতিফলন ঘটে।
নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ রক্ষা পাবেন, আগামী বাজেটকে ঘিরে এমন প্রত্যাশা তাদের। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেন ধীর না হয়– সেই দিকেও নজর রাখতে হবে। মত ও পথের প্রস্তাব হচ্ছে, সরকারকে ঋণ কম নিতে হবে আর আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকবে, জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের সার্বিক রূপ তেমন হোক। বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতি কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও সেসব মোকাবিলায় আমরা সঠিক পথেই আছি। আইএমএফ আমাদের অর্থনীতির এই দৃঢ়তা বুঝেই ঋণ দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃৃত্বের সরকারের সময় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ে। গত প্রায় দেড় দশক ধরে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে টাকার অংকে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু মূল বাজেটের যে আকার, সে তুলনায় এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ প্রত্যাশিতভাবে বেড়েছে, এটা বলা যাবে না। আমাদের মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধির চমকপ্রদ উন্নতি হয়েছে। এ দুটি বিষয়ের আশাজাগানিয়া উন্নতির সুফল দীর্ঘ মেয়াদে পেতে হলে সুদূরপ্রসারী ভাবনা ও পরিকল্পনার সঙ্গে শিক্ষা খাতে বিনোয়োগ, বরাদ্দ বাড়াতে হবে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে এ খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ, বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো ও নীতি প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই।
মোট বাজেটের ২০ শতাংশ আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের যে দাবি শিক্ষাবিদরা জানিয়ে আসছেন অনেক বছর ধরে, এর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ২০২২-‘২৩ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ১২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। ২০২১-‘২২ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল মূল বাজেটের ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর আগের বছরের পরিসংখ্যান প্রায় একইরকম। এবারের বাজেটে শিক্ষাখাত বরাদ্দ আরো বাড়ানো হোক। কারণ, মানবসম্পদ উন্নয়নের সবচেয়ে বড় হলো শিক্ষা খাত।
কৃষিখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়ে বলার আগে খ্রিষ্টীয় যাজক থমাস ম্যালথাসের লক্ষ করা আলোচিত বৈপরীত্য প্রসঙ্গে বলা যায়- যত্ন নিলে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে আর জনসংখ্যা বাড়ে যত্নের অভাবে। সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল দেশের কৃষির বিকাশ ও সাফল্য। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সুনজর পড়ায় গত কয়েক বছর ধরে দেশে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বেড়েছে। ২০২২-’২৩ অর্থবছরে বাজেটে কৃষিখাতে ২৪ হাজার ২২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এর আগের অর্থবছরে ছিল ১৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে দাঁড়িয়েছিল ১৮ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষি হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত। এ খাতে এবারও বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানাই।
অর্থ বিভাগের উদ্যােগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে সম্প্রতি আলাদা আলাদা প্রাক-বাজেট বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অর্থনৈতিক সংকট, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট নিয়ে বৈঠকগুলোতে মূল্যবান প্রস্তাব এসেছে বলে মত ও পথের সহযোগী গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিবেদন প্রচারিত, প্রকাশিত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা ও অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোবিষয়ক সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বাজেটে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে মত ও পথের প্রত্যাশা। অবকাঠামো খাতেও বরাদ্দ বাড়ানো হোক। এ খাতে ব্যয় করা হলে এর থেকে আয়ও করা যায়। এমনকি ঘাটতি বাজেট শুধু দায় সৃষ্টি করে না, ঘাটতি দিয়ে সক্ষমতা বাড়ানো গেলে এবং অবকাঠামো খাতে ব্যয় করা হলে, তা থেকেও আয় করা সম্ভব বলে অর্থনীতিবিদদের অভিমত।