জাতীয় সংসদের নির্বাচন আসন্ন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ছোট ছোট সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটে চলছে। পর্যায়ক্রমে অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। এর জন্য জনসাধারণকেও জাগ্রত ও সক্রিয় হতে হবে। সব দায়িত্ব শুধু প্রশাসনের ওপর চাপালে ঠিক হবে না। ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ও করণীয়-অকরণীয় সম্পর্কে জনমনে পরিচ্ছন্ন ধারণা দরকার।
নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার কথা বলা যায়, কিন্তু বাস্তবে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা সম্ভব নয়। সংবিধান থাকবে। সংবিধানের আওতায় ভোগ করতে হবে স্বাধীনতা। প্রয়োজনে সংবিধানের সংশোধন, সংবিধানের ধারাবাহিকতায় নতুন আইন জারি করার সুযোগ আছে। তবে সব প্রচেষ্টার মর্মেই থাকতে হবে ‘সদিচ্ছা’। সদিচ্ছার অভাব ঘটলেই সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়।
দুর্ভাগ্য আমাদের যে বাংলাদেশের একান্ত অভ্যন্তরীণ এই বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ এবং আন্তঃরাষ্ট্রিক কোনো কোনো সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন মানবাধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশের সরকারের ওপর সীমাহীন চাপ সৃষ্টি করে চলছে। বাংলাদেশের সরকার চাপে নতি স্বীকার না করে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষা করে চলছে। এত দূর এসে এখন যদি সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে নতি স্বীকার করে, তাহলে জনগণ আহত বোধ করবে এবং তার ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন কমতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষায় অটল থাকলে জনগণ অবশ্যই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল থাকবে। মানবাধিকার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এভাবে এগিয়ে আসার আগেই যদি সরকার বলিষ্ঠতা ও দৃঢ়চিত্ততা প্রদর্শন করত, তাহলে তার ফল সব পক্ষের জন্যই কল্যাণকর হতো। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যেসব দল সরকারের বিরোধিতা করছে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চাইছে, তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য সরকারের অবশ্যই আলোচনায় বসা কর্তব্য।
রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে চলছে। ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যে জাতীয়তাবোধ, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির চেতনা এবং নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই ঐক্য রক্ষা করা হলো না। কেন হলো না—এ প্রশ্ন মনে হয় এখন আর কারো মনেই জাগে না। অতীত ও ভবিষ্যতের দিকে কেউ তাকাতে চায় না।
স্বাধীনতা অর্জন করলেই তা থাকে না, স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও নিরন্তর সাধনা ও সংগ্রাম চালাতে হয়। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য অনেক কিছু করতে হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে তেমন কিছু করা হয়নি। এর মধ্যে অর্ধশতাব্দী চলে গেছে, গোটা পৃথিবীই বদলে গেছে। মনমানসিকতার দিক দিয়ে মানুষও বদলে গেছে। ‘ভোগবাদ ও সুবিধাবাদ’ এখন রাজনীতিবিদদের এবং কথিত বিশিষ্ট নাগরিকদের মূল চালিকাশক্তি। সাধারণ মানুষের প্রবণতা কেমন?
সরকার অটল থাকলে জনগণ নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল থাকবেমানবস্বভাবের দিকটাতে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। মানুষ নিজের স্বাধীনতা চায়; অন্যের জন্যও কি তা চায়? অন্যকে তো সে নিজের বশে রাখতে চায়। মানুষ নিজের জন্য যেমন করে স্বাধীনতা চায়, অন্যের জন্যও যদি তেমনি করে স্বাধীনতা চাইত, তাহলে অনেক সমস্যা সৃষ্টিই হতো না, আর সব সমস্যারই সমাধান অনেক সহজ হতো। বাংলাদেশে চিন্তার ও কর্মের জগতে যাঁরা এখন খুব সক্রিয়, তাঁদের কয়জনে সর্বজনীন কল্যাণের কথা ভাবেন? ক্ষমতাবান ও ক্ষমতালিপ্সুদের মধ্যে কে বা কারা আত্মস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সর্বজনীন কল্যাণের কথা চিন্তা করেন?
অনেকে মনে করেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট দ্বারা বাংলাদেশের নাগরিকদের, বিশেষ করে সাংবাদিক ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের মত প্রকাশের সুযোগ দারুণভাবে খর্ব করা হয়েছে। এই আইনে যেভাবে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে, মামলায় শাস্তি হচ্ছে, তাতে আমাদের জাতীয় জীবনে ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ জোরদার হচ্ছে। এই কথাগুলো শুধু আমার নয়, অনেকের। কোনো কোনো সংস্থা ও সংগঠন থেকেও এসব কথা ক্রমাগত বলা হচ্ছে। কথাগুলো পত্রপত্রিকায় আসছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। মনে হয়, সমস্যার আশু সমাধান আশা করা হচ্ছে। সংবিধানের মূল স্পিরিট অবলম্বন করে এবং জনস্বার্থ বিবেচনা করে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের পরিবর্তন করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা এখন আশা করা হচ্ছে, ভোগবাদী ও সুবিধাবাদী নেতৃত্বের পরিমণ্ডলে তা কিভাবে অর্জন করা যাবে? যাঁরা নেতৃত্বে থাকবেন, তাঁদের অন্তর্গত চালিকাশক্তির মর্মে দরকার সর্বজনীন কল্যাণবোধ ও সৃষ্টিশীলতা। যাঁরা জোর-জবরদস্তি ও অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে নেতা হতে চান, তাঁদের নেতৃত্বের আসনে বসানো যাবে না। কারা নেতৃত্বে আসীন হবেন, তা নির্ধারণ করতে হবে জনসাধারণকে। সেটা কিভাবে সম্ভব হবে, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা দরকার। সাধারণ মানুষ চালিত হতে পারে লোভ ও ভয় দ্বারা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিভাবে কতটা সম্ভব হবে?
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে চিন্তার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা শুধু সরকারি আইন-কানুনের দ্বারাই ব্যাহত হচ্ছে তা নয়, ব্যাহত হচ্ছে সরকারের বাইরেও নানা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের দ্বারা। অনেক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো পরিচালিত হয় পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের পরিবেশিত অর্থের দ্বারা। যাঁরা অর্থ প্রদান করেন, তাঁদের প্রকাশ্য ও গোপন আদেশ-নির্দেশ মান্য করে অর্থগ্রহীতাদের কাজ করতে হয়। এতে অর্থগ্রহীতাদের কাজের দ্বারা বাংলাদেশ অল্পই উপকৃত হয় এবং বাংলাদেশের পরনির্ভরতা বাড়তে থাকে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার কিংবা সংস্কার করার জন্য দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে এখন যে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে সরকার যদি কিছু করে, তাহলে আসন্ন নির্বাচনে ভোটের রাজনীতিতে সরকারি দলের কিছু সুবিধা হলেও তা দ্বারা দীর্ঘস্থায়ী কোনো সুফল হবে না। আসলে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সব দিক দিয়েই জাতির জীবনে জমাট বেঁধে আছে অজস্র সমস্যা। এসবের সমাধান করতে হলে তার জন্য দরকার বহুমুখী নতুন চিন্তা-চেতনা। শুধু নির্বাচনে এবং একটি-দুটি সমস্যায় গোটা জাতির চিন্তা-ভাবনাকে আবদ্ধ রাখলে তার ফল তো ভালো হবে না।
আমাদের জাতির ভেতরে যে চিন্তা-ভাবনা, তাতে সেই ধরনের চিন্তার উন্মেষের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলো চলছে ‘ভোগবাদ ও সুবিধাবাদ’ অবলম্বন করে। তারা কর্তৃত্ব করতে চায় দুনিয়াব্যাপী সব জাতি ও রাষ্ট্রের ওপর, যেন মুসোলিনি-হিটলারের প্রেতাত্মা ভর করে আছে তাদের মস্তিষ্কে।
আমাদের রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা তার অনুকূল নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ ছেড়ে অন্য কোনো রাষ্ট্রে চলে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। তাঁরা নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে চান পশ্চিমা কোনো রাষ্ট্রে। প্রকৃতপক্ষে কোনো ধরনের দেশপ্রেম-স্বাজাত্যবোধ তাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘ঘরকুনো বাঙালি’ এখন ‘ঘরবিমুখ বাঙালি’ হয়ে পড়েছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা কী শিখছে? যা দরকার, তা কি শিখছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে? গবেষণার নামে যে কর্মকাণ্ড করতে তরুণ শিক্ষকদের বাধ্য করা হচ্ছে, তা একেবারেই মেধা বিধ্বংসী—সৃষ্টিবিরোধী। কঠোর বিধি-বিধান ও নিষ্প্রাণ প্রথা-পদ্ধতি দিয়ে শিক্ষকদের নিয়োগ লাভের জন্য, চাকরিতে স্থিতির জন্য এবং পদোন্নতির জন্য গবেষণা করানো হচ্ছে। এতে গবেষকের ইচ্ছার স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, বিষয় নির্বাচনের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি অল্পই রাখা হচ্ছে। এই পরিবেশে চলমান কোনো ধারায় প্রকৃত জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান লোকের আত্মপ্রকাশ অসম্ভব। শিক্ষকদের অবস্থা ভালো না হলে শিক্ষার্থীদের অবস্থা ভালো হবে কিভাবে? বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের ও সৃষ্টিশক্তির স্বাভাবিক বিকাশের পরিপন্থী। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাইরে দেশের নামকরা সব গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরকার অবস্থাও আশাপ্রদ নয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার সব পর্যায়েই বড় রকমের সংস্কার দরকার।
বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঋণখেলাপি ও অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ, মুক্তিপণ ইত্যাদি দ্বারা সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করতে হবে। আসলে পর্যায়ক্রমে আমাদের গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার দরকার। সেই ধারায় চিন্তাচর্চা ও নতুন চিন্তার ধারা সৃষ্টি করা দরকার। কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে কুসুমাস্তীর্ণ পথ সন্ধান করতে হবে।
লেখক : সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়