অনেকে সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ার গতিহীন ঘূর্ণিতে পড়ে হাঁপিয়ে উঠছেন। খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বারবার তাগাদা দিয়েও সরকারি নিয়োগে গতি আনতে পারছে না। একদিকে সীমিত পদের কারণে তুমুল প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সময় ক্ষেপণে নিরাশ চাকরিপ্রত্যাশীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়োগ কার্যক্রমে শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনাগ্রহ, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ, দুর্নীতি এবং মামলাসংক্রান্ত কারণে সরকারি নিয়োগে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
নিরাশার মধ্যেও আশার খবর হলো– বিসিএসের গতি বাড়াতে এবং নিয়োগের সময় কমিয়ে আনতে গত ১১ মে সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি) নতুন চার সদস্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
নিয়োগে ধীরগতির ক্ষেত্রে বদনাম কামানোর শীর্ষে রয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। সম্প্রতি এ অধিদপ্তরের নিয়োগসংক্রান্ত দুর্নীতির কারণে এক যুগ্ম সচিবকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়।
ডাক অধিদপ্তরের উপজেলা পোস্টমাস্টার এবং পরিদর্শকসহ মোট ছয় পদে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আবেদন চাওয়া হয়। ২০২২ সালের জুনে ‘পোস্টমাস্টার’ পদের লিখিত এবং নভেম্বরে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ছয় মাস হতে চললেও অপেক্ষায় থাকা চাকরিপ্রার্থীরা জানেন না কবে প্রকাশ হবে ফল। আবেদনের দেড় বছর পার হতে চললেও পরিদর্শক পদের লিখিত পরীক্ষা এখনও হয়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টাফ অফিসার এবং স্টেশন অফিসার ১২তম গ্রেডের এ দুই পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। এমসিকিউ এবং লিখিত পরীক্ষা হয়েছে যথাক্রমে সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে। এর মধ্যে স্টাফ অফিসারের লিখিত পরীক্ষার ফল হলেও মৌখিক কবে হবে সেই অপেক্ষায় দিন গুনছেন চাকরিপ্রার্থীরা। স্টেশন অফিসারের লিখিত ফলই এখনও প্রকাশ হয়নি, তাই মৌখিক পরীক্ষা বহুদূর।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি চাকরির পদসংখ্যা ১৯ লাখ ১৩ হাজার ৫২টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে নতুন নিয়োগ দেওয়ার মতো পদ খালি আছে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি। গত ২ সেপ্টেম্বর বিসিএস ছাড়া বিভিন্ন ক্যাটাগরির শূন্য পদ পূরণ করতে নির্দেশ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
বিসিএসে নিয়োগের ক্ষেত্রে পিএসসি থেকে প্রায় প্রতি বছরই শূন্য পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে ৩ থেকে ৪ বছর সময় লেগে যাচ্ছে। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সম্প্রতি সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি বিভিন্ন নিয়োগ কার্যক্রম দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ দেন।
বিসিএসের গতি বাড়াতে ও নিয়োগের সময় কমিয়ে আনতে পিএসসির সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ করার আইন পাস করে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় পিএসসিতে নতুন চার সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি নিয়োগে দীর্ঘ সময় লাগার বড় একটি কারণ দপ্তর বা সংস্থার প্রধানরা নিজেদের চাকরির সময়ে হয় নিয়োগ শেষ করতে চান না, না হয় নিয়োগ দিতে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করে সাবেক এক দপ্তরপ্রধান (বর্তমানে সচিব) নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, বেশিরভাগ দপ্তর-সংস্থার প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান অতিরিক্ত সচিবরা। এখান থেকে যারা সচিব হওয়ার আশায় থাকেন, তারা নিয়োগ সংক্রান্ত কাজ শেষ করতে চান না।
কারণ, এ সময় অনেক মন্ত্রী ও সচিবের তদবির থাকে। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তর-সংস্থায় কর্মরত অন্য কর্মকর্তারাও নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতে চান। এতে সবাইকে খুশি করা যায় না। ফলে ভবিষ্যতে সচিব হওয়ার পথে সমস্যা হতে পারে।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্বে থাকার সময় তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে ত্রুটিমুক্ত নিয়োগ দিয়ে সাধারণের কাছে প্রশংসা কুড়ালেও ক্ষমতাবানদের চক্ষুশূল হয়ে ভিন্ন আদলে শাস্তিও পেয়েছেন।
নিয়োগ জটিলতার বিষয়ে তার মন্তব্য জানতে চাইলে বলেন, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরও কোনো চাকরি পরীক্ষার ফল বছরের পর বছর ঝুলে থাকা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সরাসরি অনেক কিছুই বলা যায় না, একটু ঘুরিয়ে বলি, সব শেষ হওয়ার যখন কোনো নিয়োগ পরীক্ষার ফল ঝুলিয়ে রাখা হয়, তখন সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
এক প্রশ্নের জবাবে কবীর জানান, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিয়োগ এড়িয়ে চলতে চান, এটাও সত্য। এমনটা করা উচিত নয়। একজন কর্মকর্তা সৎ ও দক্ষ হলে তিনি কেন ভয় পাবেন?
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারি নিয়োগে একটু সময় লাগে, এটা সত্য। এর মধ্যে করোনাকাল যাওয়ায় সেটা আরও বেশি সময় নিয়েছে। করোনা পরিস্থিতি থেকে মোটামুটি স্বাভাবিক হওয়া শুরু করতেই জনপ্রশাসন থেকে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরগুলোকে নিয়োগ কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেসব নিয়োগে মামলা সংক্রান্ত ঝামেলা নেই, সেগুলো দ্রুত করতে প্রয়োজনে আবারও নির্দেশনা পাঠাব।