সাহসী নায়ক, দুর্ভাগা ঋণী

হাসান শান্তনু

জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু তখন তথ্যমন্ত্রী। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একটি প্রতিনিধি দল কিছু দাবি নিয়ে যায় তাঁর কাছে। ওই দলে সদ্য প্রয়াত অভিনেতা আকবর হোসেন পাঠান ফারুকও ছিলেন। দাবি পূরণের আশ্বাস দেন মন্ত্রী; কিন্তু কথা রাখেননি। বিষয়টি পরে একাত্তর টিভির টকশোতে আলোচনায় আসে। এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ফারুক ঘটনার কথা জানিয়ে ইনুকে রাখঢাকহীনভাবে ‘মিথ্যাবাদী’ বলেন। এ দেশের শিল্পী সমাজ দাবি-দাওয়া নিয়ে কতো মন্ত্রীর কাছে গেছে, এর ঠিক সংখ্যা বের করা দায়িত্বপূর্ণ অনুসন্ধান ছাড়া সম্ভব নয়।

দাবি পূরণ না হওয়ায় মন্ত্রীকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলার সৎসাহস ফারুক ছাড়া অন্য কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীর দেখানোর নজির নেই। আমৃত্যুই সাহসী ছিলেন তিনি। পয়সাকড়ির জন্য আপসটাপস করলে মৃত্যুর পর এতো বড়ো ‘ঋণের বোঝার’ গুজবটা তাঁর বিরুদ্ধে ছড়াতো না। যে ঋণটা ছিলো, সেটা ২০০৯ সালেই ‘মিটমাট’ হয়ে যেতো! মৃত্যুর পর তাঁর মতো ঢাকার সিনেমার আর কোনো অভিনেতার বিরুদ্ধে এতো ‘ঋণের’ অপবাদ ছড়ায়নি।

অভিনেতা রাজ্জাক, যাঁর বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে কর (ট্যাক্স) ফাঁকি দেওয়ার গুরুতরো অভিযোগ ছিলো, যাঁর কাছে রাজস্ব বোর্ড কর চাইলে ‘অসুস্থ’ হয়ে পড়তেন, করের ‘ঝামেলামুক্ত’ থাকতে যিনি জীবনের শেষ দিনগুলোতে কাজী হায়াতের মতো জাতীয়তাবাদী ঘরানার নির্মাতার সঙ্গে ভোল পাল্টে রাতারাতি আওয়ামী লীগের ‘সরকারপন্থি’ বনে যান, তাঁর মৃত্যুর পর এসব বিষয়ে একটাও কথা উঠেনি। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী, মোল্লা ক্ষ্যাপানো কথাবার্তা বলার বিষয়ে ‘অতি সচেতন’ ছিলেন নায়ক রাজ্জাক। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে কখনোই কোনো কথা বলতেন না।

দুর্ভাগ্য সঙ্গে বয়ে বেড়ানো ফারুক আদর্শিক অবস্থানের কথা যে কোনো সময় বলতেন পরম সাহসের সঙ্গে (যা অনেকের কাছে ‘বোকামি’)। তাঁর বিরুদ্ধে নিন্দা, সমালোচনা, অপবাদ ছড়ানোর বড়ো দাগে কারণ তিনটি।

এক. বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুকের প্রগতিশীল ও ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করিনি’ বলে মুক্তিযুদ্ধের সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান; দুই. ‘ক্লিন শেভড’ মৌলবাদী, ‘বেবি ফেসড’ দুর্নীতিগ্রস্ত আন্দালিব রহমান পার্থের নির্বাচন করা সংসদীয় আসন থেকে ফারুকের সংসদ সদস্য হওয়া। ফারুক আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য হলেও বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক সঙ্গী পার্থের সঙ্গে পেরে উঠেননি। অদৃশ্য কিছু শক্তি বরাবরই ফারুকের বদলে পার্থকে সমর্থন করে। মঞ্জুর ছাওয়াল পার্থই প্রথম ফারুকের বিরুদ্ধে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যাংকঋণের কথিত তথ্য সামনে আনেন; তিন. ফারুকের দুর্ভাগ্য।

গার্মেন্টস ব্যবসায় জড়িয়ে ঋণগ্রস্ত, একটি চক্রের ‘প্রতারণার’ শিকার- এমন অভিযোগে ফারুক নিজেই সংবাদ সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগের নেতৃৃত্বের মহাজোটের সরকারের আমলে। তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নেন ২০০৯ সালে। কৈশোর কাল থেকে শেষ নিঃশ্বাসের ক্ষণ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী ফারুকের দল ক্ষমতায় টানা প্রায় দেড় দশক ধরে। এ দলের টিকিটে তিনি সংসদ সদস্যও হয়েছেন। কোনো প্রভাব খাটিয়ে ঋণের টাকা লোপাটের কথা ভাবেননি। ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখেছেন তাঁর গাজীপুরের স্বপ্নের কারখানা। তাঁর ঋণের পরিমাণ প্রায় পনেরো বছরের সুদ মিলিয়ে ১০১ কোটি টাকা। সেটা কিছুতেই সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা নয়। অথচ তাঁর মৃত্যুর পর তেমন অপপ্রচারই চলছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে।

দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় ব্যাংকের এ ঋণ ‘সামাল’ দেওয়ার ক্ষমতা কোনো কোনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানেরও থাকে। সংসদ সদস্য হয়েও ‘বোকা’ হওয়ায় ফারুক তা করতে পারেননি। কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার ভাওরখোলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক সরকার আব্বাসীর কথা বলা যাক।

ঢাকার সিনেমার দর্শকনন্দিত অভিনেতা সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি ও কুখ্যাত সন্ত্রাসী ফারুক আব্বাসী বছর তিনেক আগেও সরকারদলীয় ‘বড় নেতা’ ছিলেন। এর আগে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পদে ছিলেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের একসঙ্গে তিনজনকে হত্যাসহ কমপক্ষে ছয়টি হত্যা মামলারও আসামি তিনি। পুরান ঢাকার একসময়ের ‘শুটার আব্বাসী’, বা ‘কিলার আব্বাসীর’ কাছে ব্যাংকঋণ হিসেবে ১০১ কোটি টাকা সামাল দেওয়া মামুলি ব্যাপার।

তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দৃঢ়চেতা ফারুককে কিছুটা ‘পদবি কাতুরে’ হতে দেখা যায় একবার। ‘গান-বাজনা হারাম বলে ইসলামে উল্লেখ নেই’- এ বক্তব্যের জন্য শরিয়ত সরকার বয়াতিকে ‘অপরাধী’ হিসেবে ‘চিহ্নিত’ করা হয় সংসদে। সংসদ সদস্য হয়েও ফারুক তখন এর প্রতিবাদ করেননি। তাঁর অভিনীত সত্তরের দশকের ‘নয়ন মনি’ সিনেমার একটা গান একই কথার। ‘কোন কিতাবে লেখা আছে গো, হারাম বাজনা গান/ দাউদ নবির বাঁশির সুরে…’। হয়তো সংবিধানের সত্তর নম্বর অনুচ্ছেদের কারণেই সংসদে সেদিন ফারুক চুপ ছিলেন।

যে দেশের মাটি ছু্ঁয়ে দিলে শহিদ ও বীরযোদ্ধাদের পবিত্র রক্তে ভিজে যায় হাতের সব আঙুল, সে দেশে ফারুকরাই নমস্য। তাঁরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, গুজব ছড়ানো সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে রুখতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনকেই এগিয়ে আসতে হবে।

হাসান শান্তনু: সাংবাদিক, গণমাধ্যম গবেষক।

শেয়ার করুন