সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও রাষ্ট্রপিতা (ফাউন্ডিং ফাদার অব দ্য নেশন) বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের বিশ্বশান্তির প্রতীকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার আজ সুবর্ণজয়ন্তী। পঞ্চাশ বছর পূর্তি হচ্ছে। ১৯৭৩ সালের এ তারিখে (২৩ মে) সমগ্র জীবনের শান্তি দর্শন বিবেচনায় তাঁকে ‘জুলিও কুরি পদকে’ ভূষিত করে বৈশ্বিক প্রগতিশীল সংস্থা বিশ্ব শান্তি পরিষদ। যা ছিলো অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বাঙালি জাতির ইতিহাসে আগেই অধিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, একইসঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রনেতার প্রথম আন্তর্জাতিক শান্তি পদক লাভ। রাষ্ট্রপিতা সেদিন বঙ্গবন্ধু উপাধি ছাপিয়ে বিশ্ববন্ধুতে রূপান্তরিত হন। বঙ্গবন্ধুর আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তির পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
বিশ্বের শান্তির জন্য সর্বোচ্চ পদক জুলিও কুরি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বশান্তির অবিস্মরণীয় দূত। অকুতোভয় শান্তিকামী ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু জুলিও কুরি পদকে ভূষিত হয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ে বাঙালি জাতিকেও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে ওই পদকপ্রাপ্ত বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্বদের নামের তালিকায় তাঁর নামের সংযোজন প্রমাণ করে, তিনি বিশ্বজুুড়ে মর্যাদায় হিমালয়সম উচ্চতায় অধিষ্ঠিত। জাতি আজ কৃতজ্ঞ চিত্তে ও গভীর শ্রদ্ধায় তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করবে। দিনটিকে গর্ব, অহংকারভরা আয়োজনের সঙ্গে মানুষ উদযাপন করবে। এ উপলক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থার উদ্যােগে আজ দেশজুড়ে কর্মসূচি উদযাপন করা হবে।
দিবসটি যখন এসেছে, ঠিক তখন নানা কারণে অস্থির সময়ের মুখোমুখি বিশ্ব, এর বিভিন্ন প্রান্তে রক্তারক্তি, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ চলমান, নানা দেশে অশান্তির ছায়া বিরাজমান। দিবসটির তাই বৈশ্বিক তাৎপর্যও রয়েছে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর শান্তি দর্শনের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায়, তাঁর নীতি অনুসরণ করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সময় দেওয়া তাঁর ভাষণগুলোর আহবান বাস্তবায়নের মধ্যে আছে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার বীজমন্ত্র। তিনি বিশ্বের সব প্রান্তের মুক্তিকামী মানুষকে সমর্থন যুগিয়েছেন। অবিচল কণ্ঠে তিনি শোষিতের পক্ষে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তিনি ছিলেন তাঁদের কণ্ঠস্বর।
১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি সম্মেলনের আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক প্রদান অনুষ্ঠানে বিশ্ব শান্তি পরিষদের ওই সময়ের মহাসচিব যেভাবে তাঁকে মূল্যায়িত করেন, সেই বক্তব্যও এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নন, তিনি বিশ্বের। তিনি বিশ্ববন্ধু, বিশ্বশান্তির দূত।’ বাঙালির মুক্তির আন্দোলন ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর জুলিও কুরি পদকের জন্য তাঁর নাম ঘোষণা করে।
পরিষদের ১৪০টি দেশের অন্তত ২০০ সদস্যের মূল্যায়নে বঙ্গবন্ধুর নাম নির্বাচিত হয়। তাঁরা একমত হয়েছিলেন, সারাজীবনের দর্শন আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কত্বের প্রেক্ষাপটে তাঁকে ওই পদক দেওয়ার বিষয়ে। নোবেলজয়ী ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডেরিক জুলিও কুরির নামে প্রতিষ্ঠিত এ পদক দেওয়া হয় বিশ্ববরেণ্য সেসব ব্যক্তিত্বকেই, যাঁরা মানবতা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের স্বপ্ন ছিলো বাঙালি জাতির শান্তিময় সমৃদ্ধ জীবন, একইসঙ্গে বিশ্বশান্তির। সেই লক্ষ্যে তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়ে গেছেন। শান্তিহীন পৃথিবীতে তাঁর শান্তি পদক প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তীতে মত ও পথের দুটি প্রস্তাব। এক. বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর নামে আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার প্রবর্তন করা হোক। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যেসব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান সংগ্রাম, আন্দোলন করছে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেসব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে এ পুরস্কার দেওয়া হোক। এর মধ্য দিয়ে শান্তির প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিচল আস্থার বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছাবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করে বিশ্বশান্তির প্রতি আমাদের রাষ্ট্রীয় অবস্থানের কথা আরো স্পষ্ট করা যাবে।
দুই. বঙ্গবন্ধুর মানবতা ও বিশ্বশান্তির দর্শন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে তাঁর নামে রাষ্ট্রীয় উদ্যােগে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হোক। যে প্রতিষ্ঠান শান্তির প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিচল আস্থার বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরবে। কারণ, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাই ছিলো তাঁর জীবনের মূলনীতি। জীবনভর আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন শান্তির অন্বেষণে নিবেদিত। নানা রকমের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিপর্যস্ত আজকের পৃথিবীতে মানবজাতির সামনে শান্তির কোনো বিকল্প নেই।