সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চট্টগ্রাম নগরীতে উদ্বোধনের অপেক্ষায় ৪ মেগা প্রকল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

গত ১৫ বছরে বৃহত্তর চট্টগ্রামের সড়ক, বন্দর, উড়াল সেতু, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পানি শোধনাগার, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিশেষ অর্থনৈতিক জোনসহ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে সরকার। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কৌশল নিয়েও কাজ করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। টানা তিন মেয়াদে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটির প্রধান হাতিয়ার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রচার। এ লক্ষ্যে নির্বাচনের আগে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৪টি বড় প্রকল্প একসঙ্গে উদ্বোধনের সম্ভাবনা রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামবাসীকে উন্নয়নের চমক দেখাতে চায় সরকার। সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হবে প্রকল্পগুলো।

পর্যটননগরী কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত রয়েছে। দেশের প্রধান পর্যটন স্পট ধরা হয় এই জেলাকে। একে রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত করার ফলে পর্যটন ছাড়াও কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৮টি উপজেলার ব্যবসা, বাণিজ্য ও যাতায়াতে বড় ভূমিকা রাখবে। এছাড়া চীনের সাংহাই সিটির আদলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে বন্দরনগরীর সংযোগ স্থাপনে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে বিমান বন্দরের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনের জন্য করা হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট যানবাহনসহ সহজ যোগাযোগের জন্য বায়েজিদ লিংক সড়ক করা হয়েছে। নানা জটিলতার অবসান ঘটিয়ে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে।

প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নকারী সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী, এসব প্রকল্প একসঙ্গে উদ্বোধন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর নাগাদ প্রকল্পকাজ সম্পন্ন বা মানুষের জন্য উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা। সবকিছু ঠিক থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজে এসব মেগা প্রকল্প উদ্বোধনের কথা রয়েছে।

গত ১৫ বছরে বৃহত্তর চট্টগ্রামের সড়ক, বন্দর, উড়াল সেতু, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পানি শোধনাগার, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিশেষ অর্থনৈতিক জোনসহ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে সরকার। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে এসব সিংহভাগ প্রকল্প ভূমিকা রাখলেও কিছু প্রকল্প নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বিরোধিতা করেছিলেন। তবে সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রচার সেল থেকে নিয়মিত প্রচার করা হয়।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রী বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, বন্দরনগরী হিসেবে চট্টগ্রামের গুরুত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুঝেছেন। এজন্য তিনি এখানে মেগাপ্রকল্প দিয়েছেন। এসব প্রকল্প শুধু চট্টগ্রামের নয়, দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে। প্রকল্পগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। আশা করছি, চট্টগ্রামসহ সারা দেশের মানুষের সঙ্গে তিনি উদযাপনে অংশ নেবেন।

বঙ্গবন্ধু টানেল খুলছে সেপ্টেম্বরে

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি হয় গত বছর নভেম্বরে। এটিও ঘটা করে উদযাপন করা হয় সেসময়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। গত বছরের নভেম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল চালু করার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। তবে ডিসেম্বরে প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরো এক বছর বাড়ানো হয়। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পকাজ ৯৭ দশমিক ২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে জানান, আগামী সেপ্টেম্বরে খুলছে টানেলের দ্বার।

প্রকল্পের নথিপত্রের তথ্যমতে, মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। তবে সংযোগ সড়কসহ টানেলের সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার। নদীর নিচে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে ১০ দশমিক ৮০ মিটার ব্যাসের দুটি টিউব। প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলে টিউব দুটি থাকলেও সংযোগ পথ আছে তিনটি। এরমধ্যে একটি বিকল্প পথ হিসেবে প্রথম দুটির সঙ্গে যুক্ত থাকবে। দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রথম সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৪ মিটার। দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৩৪ মিটার। শেষটির দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৭৪ মিটার। প্রতিটির ব্যাস গড়ে সাড়ে চার মিটার। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। নদীর মাঝ পয়েন্টে এই গভীরতা প্রায় ১৫০ ফুট। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার। চট্টগ্রামে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে টানেলটি নদীর তলদেশ হয়ে চলে গেছে আনোয়ারার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থানে।

সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, টানেল চালুর পর বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে, যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুন উর রশিদ বলেন, এখন শুধু ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল কাজ চলছে। নিরাপত্তাসংক্রান্ত স্ক্যানার স্থাপন, পুলিশ ফাঁড়ি ও ফায়ার স্টেশনের নির্মাণকাজ চলছে।

সেপ্টেম্বরে ট্রেন যাবে সাগরপাড়ে

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বহুল প্রতীক্ষিত পর্যটন রেললাইন প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। তবে এর আগেই এটি শেষ করার লক্ষ্যে কাজ এগিয়ে চলছে। নির্মাণাধীন ১০০ কিলোমিটারের এই রেলপথের পাশাপাশি কক্সবাজারে একটি বিশ্বমানের আইকনিক স্টেশনসহ ৯টি রেল স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৪ শতাংশ। মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং বাকি খরচ বহন করছে বাংলাদেশ সরকার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা থেকে মাত্র সাড়ে ৭ ঘণ্টায় এবং চট্টগ্রাম থেকে আড়াই ঘণ্টায় ট্রেন পৌঁছাবে কক্সবাজারে। প্রতিদিন এক লাখেরও বেশি মানুষ যাতায়াত করতে পারবেন এই রুটে। প্রাথমিক হিসাবে, ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেনে মানভেদে প্রতি টিকেটের দাম ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকা এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পড়বে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রুটে ১০টি করে মোট ২০টি ট্রেন ডুয়েল গেজ ট্র্যাকে চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

গত বছরের শেষ দিকে সরকারি ঘোষণা ছিল- চলতি বছরের জুনে ট্রেন চলবে দেশের ৪৫তম রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আসা এ জেলায়। কিন্তু চট্টগ্রামের কালুরঘাট রেল সেতুর সংস্কার বড় বাধা। জরাজীর্ণ সেতুতে ট্রেন চালানোর সংস্কার কাজ শুরু হবে আগামী জুনে। শেষ হবে ডিসেম্বরে। তবে মধ্য সেপ্টেম্বরে সেতুটি ট্রেন চলাচলের উপযোগী হবে। সংস্কারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে এ সেতুর উপর ট্রেন চলতে পারবে।

প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মফিজুর রহমান বলেন, বর্তমানে ৭৫ কিলোমিটারের বেশি রেললাইন দৃশ্যমান। ৯টি স্টেশনের সবকটির অবকাঠামো কাজ সম্পন্ন। এখন ফিনিশিংয়ের কাজ চলবে। উদ্বোধনের আগে শতভাগ কাজ সম্পন্ন না হলেও ট্রেন চালানোর মতো উপযোগী হবে।

একসঙ্গে উন্মুক্ত হবে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নগরীর লালখানবাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর বা পতেঙ্গা সৈকত পর্যন্ত নির্মিত হচ্ছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে নগরীর সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হবে কর্ণফুলী টানেলের সঙ্গে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে। ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই উড়াল সড়কের মোট নির্মাণ ব্যয় ৪ হাজার ৩৬৯ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার ৮১৯ টাকা।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে উড়াল সড়কের পতেঙ্গা থেকে নিমতলা বিশ্বরোড পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার খুলে দেওয়া হবে। তা বাস্তবায়ন হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ পুরো ১৬ কিলোমিটার উড়াল সড়ক উদ্বোধন করে একসঙ্গে খুলে দেওয়া হবে।

বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড প্রকল্পের জটিলতা নিরসন

৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চট্টগ্রামের বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড ঘিরে নানা জটিলতা পোহাতে হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ)। একদিকে রেলওয়ের সেতু উচ্চতার অনাপত্তিপত্র, অন্যদিকে পাহাড় কাটার দায়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা ও অনাপত্তি না দেওয়ায় ১০ বছরেরও শেষ হয়নি প্রকল্পটির কাজ। এ সড়কটি দিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর যানবাহনগুলো নগরীর একে খান, সিটি গেটসহ ব্যস্ত এলাকায় না গিয়ে কম দূরত্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উঠতে পারছে না। সড়কটির ফৌজদারহাট অংশে ওভারপাসের কাজ শেষ না হলেও ২০২০ সালে যান চলাচল শুরু হয়। তবে বর্ষায় পাহাড় ধসের আশঙ্কায় কয়েক দফা বন্ধও হয়েছিল। প্রকল্পটির কাজ ৯৫ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে।

সর্বশেষ গত বছরের আগস্ট মাসে আরেক দফায় প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ৩৫৩ কোটি টাকা করা হয়। বাস্তবায়নের মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের জুন করা হয়। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় রেলের উচ্চতা আপত্তি নিষ্পত্তি হয়। বাকি অংশের কাজ চলছে। বর্তমানে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্র বাকি। সেটিও সমাধানের জোর চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে উদ্বোধন করা হতে পারে।

প্রকল্প পরিচালক আসাদ বিন আনোয়ার জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্র নিষ্পত্তি হলে পাহাড় সংরক্ষণের প্রটেকশন ওয়াল করা হবে। এছাড়া সড়কবাতির কাজসহ সেপ্টেম্বরে শেষ হবে আশা করি।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, বায়েজিদ লিংক রোডের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা চলছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজও এগিয়ে চলছে। আশা করছি, সেপ্টেম্বরের আগেই সব কাজ শেষ হবে।

শেয়ার করুন