বাংলা কবিতার বাঁকবদলের ইতিহাসে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। যে সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দোর্দণ্ড প্রতাপে রচনার জগতে বিচরণ করছিলেন এবং একটি শক্তিশালী অনুসারী গোষ্ঠী তৈরি করতেও সক্ষম হয়েছিলেন, যাঁরা ধনে ও জনে ছিলেন বাঙালিসমাজে প্রভাব বিস্তারকারী, যাঁরা মনে করতেন ঠাকুর প্রদর্শিত পথই একমাত্র সাহিত্য রচনার পথ, সেই বৃত্ত অস্বীকার করে সমাজে বাস করা সহজ ছিল না। এই কঠিন না হলেও ‘অসহজ’ পথে এগিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি রবীন্দ্রপথে সাহিত্য রচনা করেননি, বরং স্বতন্ত্রভাবে একটি পথের সন্ধানী হয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সম্পর্কে নজরুলের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল সেটির দীর্ঘ উল্লেখ হয়তো কোথাও নেই। কিন্তু তিনি যে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যপথের অনুসারী ছিলেন না, সে কথা নজরুল একটি প্রবন্ধে সুস্পষ্ট করেই বলেছেন। নজরুল লিখেছেন, “পৃথিবীতে তিন শ্রেণির লেখক আছেন, এঁদের এক শ্রেণিকে ‘স্বপ্নচারী’ বলা যায়। নোগুচি, ইয়েটস, রবীন্দ্রনাথ এই দলের।
তাঁরা পৃথিবীর বাস্তবতার ঊর্ধ্বে উঠে স্বর্গের সন্ধান করেন এবং তাঁদের পা কখনো মাটিতে পড়ে না। তাঁরা শুধু ঊর্ধ্বে উঠতে চান এবং সেখানে উঠে স্বপনলোকের গান শোনান।’ নজরুল নিজেকে এই দলে যুক্ত করেননি, করেছেন এর বিপরীত দলে। যে দল বলে, ‘স্বর্গ যদি থাকেই তবে তাকে আমরা সাধনা দিয়ে ধুলোতে নামিয়ে আনব এবং মাটির মায়ের দাসী করব।
’ কাজী নজরুল ইসলামের এই ভাষ্যে বোঝা যায়, তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যপথের প্রায় বিপরীত ধারাটি অবলম্বন করেছেন এবং এ জন্য তাঁর আত্মগর্বই আছে। বিশ্বসাহিত্যে নজরুল অনুসৃত এই ধারার অনুসারী পাওয়া গেলেও বাংলা সাহিত্যে ঠিক এই ধারা অবলম্বনকারী সাহিত্যিকের, বলা চলে সুসাহিত্যিকের তেমন কোনো পরিচয় আমরা পাই না।
কাজী নজরুল ইসলাম যখন সাহিত্যের অঙ্গনে সক্রিয়ভাবে আবির্ভূত হন, তখন বলা চলে প্রায় দেড়-দুই বছরের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কবিতা তিনি লিখে ফেলেন এবং সেগুলো পত্রিকায়ও বের হয়। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা মোসলেম ভারত পত্রিকায় তিনি লেখেন ‘সাত-ইল-আরব’ নামের কবিতা এবং ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ৫ ভাদ্র সংখ্যায় ধূমকেতু পত্রিকায় লেখেন ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতা। অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলো ১৩২৭ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ থেকে ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসের মধ্যে পত্রিকায় বের হয়।
১৩২৯ বঙ্গাব্দের ভাদ্রের পর দুই মাসের মধ্যে নজরুলের অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই প্রায় সোয়া দুই বছরে প্রকাশিত কবিতা নিয়ে অগ্নিবীণা বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে প্রায় বিস্ফোরণ ঘটায়। বিস্ফোরণ ঘটেছিল একটু আগেই। সেটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পরে। ১৩২৮ সালের কার্তিক মাসে কিংবা একই বছরের পৌষ মাসে ‘মোসলেম ভারত’ আর ‘বিজলী’ পত্রিকায় কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর সাহিত্যাঙ্গনে একটি আলোড়ন উঠেছিল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পর দেখা গেল ‘প্রলয়োল্লাস’ আর ‘ধূমকেতু’র মতো কবিতা লেখেন নজরুল। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থটি হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। প্রায় সোয়া দুই বছর ধরে যে কবিতাগুলো লেখা হয়েছে, সেই কবিতাগুলো দিয়েই প্রকাশ করা হয় ‘অগ্নিবীণা’। এতে বোঝা যায়, ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত যে চেতনা, সেটি গগনপ্রসূত নয় বা হঠাৎ করে তার আমদানি করা হয়নি। কাব্যগ্রন্থটি কবির সুচিন্তিত বিষয়ের অমিয় ধারাবাহিকতারই ফসল, যেটি নজরুল আন্ত মনে লালন করতেন। এখানেই প্রশ্নের উত্তর মেলে—নজরুল সমকালীন অন্যদের থেকে ভিন্ন চেতনা লালন করতেন, যে চেতনার সঙ্গে সমকালীন প্রচলিত চেতনা, যেটি রবীন্দ্র ঘরানায় বেশ দূরত্ব ছিল।
‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশকালে কবিতাগুলোকে নজরুল কিভাবে সাজিয়েছেন, সেটি দেখে নজরুলের মানসবিবর্তনটি আজকে খুব একটা বোঝা যাবে না। এ জন্য যেতে হবে কবিতাগুলো পত্রিকায় কিভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সেটি দেখতে। সেখানে দেখা যায়— * নজরুল প্রথমে ইসলাম ধর্মসম্পর্কিত কবিতাগুলোই লিখেছিলেন। যেমন—‘শাত-ইল আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহর্রম’, ‘রণভেরী’। এই কবিতাগুলো পর পর এবং প্রথম দিকে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। * নজরুল আগমনী কবিতাটি লেখেন, যেখানে তিনি দেবী দুর্গাকে আবাহন করেছেন এবং মন্ত্রের মতো করে কবিতায় ধ্বনিযোজনা করেছেন। * এরপর বেরিয়েছে ‘কামাল পাশা’ ও ‘আনোয়ার’ কবিতা, যেখানে মূলত ধর্মনিরপেক্ষ ভাব প্রকাশিত। তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী নেতা কামাল আতাতুর্ককে স্মরণ করে অনিন্দ্যসুন্দর কবিতা লেখেন নজরুল। * সব শেষ ধারায় আছে বিদ্রোহ। এই ধারায় একটানা লেখেন—‘বিদ্রোহী’, ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘ধূমকেতু’।
নজরুল যখন ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থটি লেখেন তিরিশের কবিকুলের আবির্ভাব তখনো হয়নি। তিরিশের কবিকুল মূলত যে আধুনিকতার সঞ্চার করেছিলেন তা পাশ্চাত্য প্রভাবিত। পশ্চিম থেকে সম্পূর্ণ উপাদান ও দর্শন নিয়ে তাঁরা বাংলায় কাব্যচর্চা করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের আধুনিকতাবাদী কবি বলে স্বীকৃতি দিয়ে উচ্চাসন প্রদান করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ এখানে কম। তার পরও বলা চলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তিরিশের কবিকুল এই দুই ধারার মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম সেতুবন্ধের কাজ করেছেন। আর এই সেতুবন্ধের সূচনা হয়েছে অগ্নিবীণার মধ্য দিয়ে। অগ্নিবীণার মধ্য দিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ থেকে বাংলা কাব্যধারাকে বিচ্ছিন্ন করে যে স্বাবলম্বী অবস্থান দান করেন সেখানে পশ্চিমী আধুনিকতার ছাপ ছিল না, ছিল স্বদেশের কাব্যভূমি থেকে নতুনতর চেতনার জাগরণ। পশ্চিম থেকে নিয়ে এলেই সেটিকে মহার্ঘ্য বলে বিবেচনা করার যে মানসিকতা, সেটি আজ যেমন আছে, সেকালেও কম ছিল না। এই মানসিকতাকে অস্বীকার করে অগ্নিবীণা বাঙালির সামনে নতুন আধুনিকতার দ্বার উন্মোচন করে। এই আধুনিকতা হলো ধর্মরক্ষা করেও ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া, বিপ্লবকে সঙ্গীকরণের মধ্য দিয়ে নতুনের গান গাওয়া। নজরুল তাঁর অগ্নিবীণার প্রথম কবিতা হিসেবে গ্রহণ করেন ‘প্রলয়োল্লাস’কে। কেন গ্রহণ করেছিলেন? ‘বিদ্রোহী’র মতো কবিতা থাকতে এবং সেই কবিতাটি সেকালে প্রায় বিপ্লব করে ফেলেছিল, সেটিকে বাদ দিয়ে অন্য একটি কবিতাকে সূচনা কবিতা করার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে।
পত্রিকায় প্রকাশের দিক থেকে দেখলে নজরুলের মানস পরিবর্তনটি স্পষ্ট বোঝা যায়। যেমন—ধর্মীয় ধারায় কবিতা লেখার পর তিনি লেখেন ধর্মনিরপেক্ষ ধারায় এবং এরপর তিনি চলে যান সরাসরি বিদ্রোহ ধারায়। এই ধারাকেই তিনি এরপর সরাসরি মান্য করেন—তাঁর জীবনে পর্বান্তরগুলো আসার আগ পর্যন্ত! নজরুল মূলত সারা জীবন ধর্মনিরপেক্ষতা ও বিদ্রোহকে মর্মে ধারণ করেছিলেন। বলা চলে, কাজী নজরুল ইসলামের সারা জীবনের দর্শনের সারসংক্ষেপ বা সিনোপসিস হলো ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থ।
লেখক : উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ