উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়,প্রয়োজন বাস্তবমুখী বাজেট

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ফাইল ছবি

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট আগামী ১ জুন সংসদে পেশ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ধারণা করা যেতে পারে, গত বছরের চেয়ে এবারে বাজেট একটু বড় হবে। সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাবটাও একটু বড় থাকবে। প্রতিবছরই খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

উন্নয়ন, রাজস্ব, প্রশাসনিক—বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ দিতে হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বাজেটে লক্ষ রাখতে হবে, বাজেটে যে ব্যয় প্রক্ষেপণ করা হবে, সেটা যেন যথাযথ হয়। অনেক সময় লাগামহীন ব্যয় হতে পারে। রাজস্ব আদায় হবে না, কর আদায় হবে না—এটা ঘাটতি। অথবা এমন কিছু প্রকল্প নেবে, যেগুলো ঝুলে থাকবে। এই বছর হবে না, আরেক বছর হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বড় থাকে, সেটার লক্ষ্য অর্জিত হয় না। ব্যয়ের মাত্রাটা কিন্তু মোটামুটি ঠিকই থাকে। কারণ ব্যয় করাটা আপেক্ষিকভাবে সহজ। সরকারের ব্যয়ের জন্য তো ধার করার অসুবিধা নেই। সরকারের ধার হলো বিদেশ থেকে আসা ঋণ। আবার দেশের ব্যাংকিং সেক্টর থেকে লোন নেবে। তারপর সঞ্চয়পত্র, প্রাইজবন্ড ইত্যাদির কাছ থেকে লোন নেবে।

কাজেই বিভিন্ন দিক থেকে ঘাটতি বা ব্যয় মেটানোটা সরকারের জন্য তেমন কষ্টসাধ্য হয় না। কিন্তু যদি আমরা লক্ষ করি যে অনেক কিছু আকাঙ্ক্ষা থাকবে, একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যয় এবং একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য, সেটা কিন্তু তেমন ফলপ্রসূ হয় না। আবার অন্যদিকে বাজেটটা বড় ব্যবসাবান্ধব হয়। কিন্তু কৃষি, ছোট, মাঝারি ও কুটির শিল্পবান্ধব হয় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলি যে বাজেটটা বাস্তবমুখী হতে হবে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের যে বাস্তবতা আছে, যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, সেই চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখে আমরা ভবিষ্যতে কিভাবে এগোব, আমাদের রূপরেখা কী, সেদিকে লক্ষ রেখে বাজেটটা করতে হবে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাজেট করে, লোকদের নানা রকম গল্প শুনিয়ে, কথার ফুলঝুরি ঝরিয়ে লাভ হবে না।

আমরা কিন্তু দেখি, বরাবরই সাধারণ মানুষের আপেক্ষিকভাবে বেশি উন্নতি হয় না। হ্যাঁ, কিছুটা উন্নতি হচ্ছে, ইনকাম কিছুটা বেড়েছে, ফলে জীবনযাত্রার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আপেক্ষিকভাবে যদি দেখেন যে যারা উচ্চমধ্যবিত্ত বা ধনী, সাধারণ মানুষের চেয়ে তাদের আয় ও সম্পদ বেড়েছে। সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য দিন দিন বাড়ছেই। এটা খালি চোখেই দেখা যায়। শহর ও গ্রামে বৈষম্য আছে। যাদের রেমিট্যান্স আসে, যাদের ধন-সম্পদ আছে, ভালো ব্যবসা আছে, রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে, তাদের অবস্থান সাধারণের তুলনায় অনেক ভালো। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবতার আলোকে বাস্তবমুখী বাজেট পেশ করতে হবে।

আরেকটা জিনিস বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের এখন বিশেষ সময়। বিশেষ সময়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাইছি। বিশেষ সময় এ জন্য বলছি, চ্যালেঞ্জগুলো কিন্তু প্রকট হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ আছে। কভিড-উত্তর এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটা নতুন বাস্তবতা। ফিন্যানশিয়াল পেমেন্ট সিস্টেম, বাণিজ্য, ইনভেস্টমেন্ট ফ্লো—সব কিছু টালমাটাল অবস্থা। এগুলো আমাদের ওপর প্রভাব ফেলছে। জ্বালানির দাম বেড়েছে, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, মেশিনের দাম বেড়ে যাচ্ছে—এসব বিবেচনায় নিয়ে যদি বিশেষ বাজেট না হয়, তাহলে বাজেট অর্থহীন হবে।

বাস্তবতার ভিত্তিতে বাজেটটা করা হবে কেন এবং বাস্তবায়ন করা হবে কেন? প্রথমত, বিবেচ্য আমাদের বাজেটটা এক বছরের জন্য। এই এক বছরের মধ্যে শর্ট টার্মের জিনিসগুলো থাকবে। সরকারের ব্যয়, উন্নয়ন ব্যয় ইত্যাদির সঙ্গে কিছুটা মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার যোগসূত্র থাকতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যয় কিছুটা মধ্যমেয়াদি বিনিয়োগ হচ্ছে, হতে হবে। সেটার যোগসূত্র দীর্ঘমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদি আমাদের অনেক প্রেক্ষিত পরিকল্পনা আছে, সেটার লক্ষ্যগুলো কী? মধ্যমেয়াদির লক্ষ্য হলো অর্থনীতিতে যে ওঠানামা হয়, নানা ঝুঁকির মুখে পড়তে হয়, সেটাকে ঠিক রাখা এবং উন্নয়নকে সামনে নিয়ে যাওয়া।

একই সঙ্গে বাজেটে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকবে। দারিদ্র্য বিমোচন, অবকাঠামো উন্নয়ন, সামাজিক খাত, শিক্ষা, দীর্ঘ মেয়াদে আমরা কী করব, সেগুলো থাকতে হবে। বাজেটের যোগসূত্র থাকতে হবে। এক বছরের বাজেট যেনতেন করে দিলাম, বাস্তবায়িত হলো না, আরেকবার দিলাম—এটা হয় না। উন্নয়নে ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। এ বছর যেটুকু উন্নয়ন করা গেল, সব ঠিক রেখে সামনের দিকে যেতে হবে। সামনের প্রগ্রামগুলো কিন্তু বর্তমান কাজের সঙ্গে যোগসূত্র থাকতে হবে। নতুবা এ বছর বাজেট করা হলো, টাকা-পয়সা খরচ করা হলো, সামনের বছরের সঙ্গে যোগসূত্র নেই, প্রকল্প শেষ হলো না। এতে অর্থের অপচয় হয়। সব তো জনগণের টাকা। জনগণের টাকার অপচয় হয়। কিছু লোক—যাঁরা বেতনভোগী, সরকারি কর্মচারী বা সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী, তাঁদেরই সুবিধা হয়। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার কোনো উন্নতি হয় না। এই জিনিসটা খেয়াল রাখতে হবে।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আমাদের রাজস্ব আদায় একবারে কম, জিডিপি ও ট্যাক্স অনুপাত ৮ শতাংশ। এটা কমপক্ষে ১৪ শতাংশ করতে হবে। নেপালের মতো দেশে ২৩ শতাংশ, ভারতে ১৫ শতাংশ। আট থেকে ১৪ একবারে করা মুশকিল। করব্যবস্থার দিকে একটু নজর দিতে হবে। প্রয়োজন হলে আধুনিকায়ন করতে হবে। ‘ট্যাক্স নেট’ বাড়াতে হবে। আমি মনে করি, রাজস্ব আয়ের ব্যাপারে প্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি নজর না দিয়ে পরোক্ষ কর, যেমন—ইনকাম ট্যাক্স, সম্পদের ওপর ট্যাক্স—এগুলোর ওপর নজর দিতে হবে। আমাদের উচ্চমধ্যবিত্ত এবং ধনী লোকের ট্যাক্সগুলোর রেটটা যত ওপরে যাবে, ট্যাক্স বাড়ার পর্যায়ে একটা ধারাবাহিকতা থাকবে। ট্যাক্স রেটটা বাড়াতে হবে বড়দের জন্য। একইভাবে করপোরেট ট্যাক্সটা রেশনালাইজ করা দরকার। যাঁরা স্টক মার্কেটে যাচ্ছেন, লিস্টেট হচ্ছেন, যাঁদের বিনিয়োগগুলো ইফিশিয়েন্ট, তাঁদের ব্যাপারে ট্যাক্স কিছুটা কম করা যেতে পারে। এর বাইরে যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে তাদের ট্যাক্স আপেক্ষিকভাবে বেশি হতে হবে।

দিন দিন আমাদের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে চলেছে। বৈদেশিক ঋণের বোঝাও বাজেটে আসে। ঋণটা যথাসম্ভব সিলেক্টিভভাবে নিতে হবে। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, আইডিবি—তাদের রেট কম। পরিশোধের সময় বেশি। যদিও তারা অনেক রকম শর্ত দেয়। শর্তগুলোর ব্যাপারে যেগুলো আমাদের নিজস্ব বিচারে, সেগুলো আমরা নেব। তারপর তাদের সহায়তা গ্রহণ করব।

দেশে যে সঞ্চয়পত্র, সেভিংস সার্টিফিকেট ইত্যাদিতে সুদ কমিয়ে দিচ্ছে, আমার মতে সেটা মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়। এটা রাখতে হবে। বলা হচ্ছে, এই উচ্চ সুদে সরকারের বেশি খরচ হয়। যে সুদটা দেওয়া হচ্ছে এটা বাংলাদেশের নাগরিকদের হাতেই যাচ্ছে। তারা খরচ করবে। তাদের আয় বাড়বে। তারা জীবনযাত্রার গুণগত মানটা বাড়াতে পারবে। সব ব্যয় যুক্তিসংগত করতে হবে।

সরকারের আয়টা তখন কম হলেও আয় ও ব্যয়ের ব্যবধানটা কম হবে। যদি আয়টা প্রজেক্ট করি বেশি, তখন অপচয় করার প্রবণতা থাকে। এই জিনিসটা লক্ষ করতে হবে।

আমাদের আরেকটি চ্যালেঞ্জ এখন ভর্তুকি ব্যবস্থাটা। আমি মনে করি জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতেই হবে। কারণ জ্বালানি একটা অত্যাবশ্যকীয় জিনিস, এটা লাক্সারি নয়। সাধারণ মানুষ যে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি ব্যবহার করে, গ্যাসের যে ভর্তুকি এটা দিতেই হবে। কিন্তু ওপরের দিকে বড় বড় ব্যবসায়ীরা ভর্তুকি চাচ্ছেন, সেটা দেখতে হবে। তাঁরা রপ্তানি করছেন, আয় করছেন। আপনি দেখুন তাঁদের রেট অব প্রফিট কত। দিন দিন কিভাবে আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। অতএব ওপরের দিকে ভর্তুকি দিতে হবে তা নয়, ব্যালান্স ওয়েতে জ্বালানির ভর্তুকি দিতে হবে।

কৃষির ভর্তুকি যেটা—কৃষকের সেচ, সার ও বীজের জন্য প্রযোজ্য, এগুলো কোনোভাবেই ওঠানো যাবে না। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বলছে, কোনোভাবেই তাদের কথা শোনা যাবে না।

তারপর কোনো কোনো ইন্ডাস্ট্রি বারবার ভর্তুকি দিয়েই যাচ্ছে। আরএমজি সেক্টরে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। সুুদের হার কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইডিএফ ফান্ডের টাকা নিচ্ছে। ভর্তুকি দিতে হবে যথাসম্ভব একবারে কৃচ্ছ্রসাধন করে। ভর্তুকি দিতে হবে এক্সপোর্ট ডাইভারসিফাই করার জন্য। চামড়া আছে, ইলেকট্রিক দ্রব্যাদি আছে, প্লাস্টিক দ্রব্য আছে, বিভিন্ন ধরনের এক্সপোর্ট আছে, সেখানে ভর্তুকি দিতে হবে। শুধু একই সেক্টরে ভর্তুকি দিয়ে গেলে আমরা হুমকির মুখে পড়ে যাব। অতএব অন্যান্য সেক্টরে ভর্তুকির নজর দেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।

সব শেষ কথা হলো, কর্মসংস্থানটা দেখতে হবে। কর্মসংস্থানের জন্য বাজেটে ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প প্রণোদনা, বিভিন্ন প্রণোদনা দিতে হবে। বিভিন্ন সেক্টরে আমি দেখেছি, ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের নানা রকম ট্যাক্স, সাপ্লিমেন্টারি ট্যাক্স, ভ্যাট, ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স থাকে। এসব ট্যাক্সের ফলে ছোট-মাঝারি শিল্প বা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কর্মসংস্থানের মূল হলো ছোট-মাঝারি শিল্প এবং সার্বিকভাবে শিল্প। আমাদের দেশে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সার্ভিস সেক্টরে আমরা জোর দিই। কৃষি এবং অন্যান্য উৎপাদন শিল্পে কিন্তু আমরা বেশি প্রাধান্য দিই না। বাংলাদেশের মতো ১৭ কোটি মানুষের দেশে কিন্তু শুধু বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্য করে আর সার্ভিস সেক্টর দিয়ে কিন্তু সমতাভিত্তিক উন্নয়ন করা যাবে না। এটা সিঙ্গাপুর বা হংকং নয়। এটা একটা বিশাল দেশ। এখানে শিল্প লাগবে। বিশেষ করে ছোট শিল্প। বিজনেস সেক্টরে শুধু সার্ভিস সেক্টর আর বড় বড় শিল্প, আমার মনে হয় এই ধরনের ফোকাস কিছুটা পরিবর্তন করতে হবে।

সরকারকে মৌলিক কতগুলো জিনিসের ওপর নজর দিতে হবে; গ্রোথ অবকাঠামো, এনার্জি, স্যোশাল সেক্টর, সামাজিক সুরক্ষা বা নিরাপত্তা মান ব্যবস্থা, কৃষি, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান—এই কয়েকটা খাতের ওপর বেশি নজর দিতে হবে। এটা দিলে দরিদ্র লোকও লাভবান হবে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় বেশি জোর দিতে হবে। কোরিয়া-থাইল্যান্ডের মতো দেশ স্বাস্থ্য খাতে ১২ শতাংশ দিচ্ছে। আর আমরা ৫ শতাংশ দিয়ে বলি যে কোরিয়া হব, থাইল্যান্ড হব। আমি মনে করি, এডিপির কিছু কিছু প্রকল্প আছে—হাজারখানেকের বেশি, তার মধ্যে অনেক প্রকল্পই কেটে ফেলা যাবে। সরকারের এখানে অর্থ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এগুলোর সুদূরপ্রসারী ও সর্বজনীন ইতিবাচক ভূমিকা নেই। কাজেই সর্বজনীনভাবে অনেকের উপকার হয়, এমন অল্পসংখ্যক এডিপি প্রজেক্ট নিতে হবে। এতে ব্যাপক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

অনুলিখন : রায়হান রাশেদ

শেয়ার করুন