ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড়ের সুবিধা তুলে নেওয়ায় ব্যাংক খাতে বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। এতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। খেলাপির এই অঙ্ক দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
রোববার (২৮ মে) বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত মার্চ-২০২৩ প্রান্তিকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সাল থেকে করোনার প্রভাব মোকাবিলায় ঋণ পরিশোধে দফায় দফায় ছাড় এবং ঋণ পুনঃতফসিলের নতুন নীতিমালা করে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন ঋণ পরিশোধে সব ধরনের সুবিধা তুলে নেওয়ার পর খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কার্যরত ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ১০টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ ব্যাংকে খেলাপি ঋণ রয়েছে ৮১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ রয়েছে—১৪ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। এরপরেই রয়েছে জনতা ব্যাংক। এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৪ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ রয়েছে সোনালী ব্যাংকে। এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার ৬ কোটি টাকা। বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা, এটা সম্মিলিতভাবে চতুর্থ সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের ব্যাংক।
পঞ্চম স্থানে আছে রূপালী ব্যাংক। এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি। ষষ্ঠ স্থানে আছে বেসিক ব্যাংক। এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৪৭৫ কোটি। সপ্তম স্থানে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১০১ কোটি। অষ্টম স্থানে রয়েছে এবি ব্যাংকের নাম। এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৬৯ কোটি। নবম স্থানে থাকা পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৪২৭ কোটি এবং দশম স্থানে থাকা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশই এখন খেলাপি। ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তমতে, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ, সন্দেহজনক ঋণ ও আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণকেও খেলাপি হিসেবে দেখাতে হবে। আইএমএফের এই হিসাবে খেলাপি দাঁড়াবে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা।
যদিও সম্প্রতি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নেতারা সংবাদ সম্মেলন দাবি করেছেন, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা এককভাবে ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। এমডিদের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন, তাদের, বিশেষ করে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব নিতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত তিন মাসের ব্যবধানে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ হয়েছে। এদিকে ঋণ আদায় না হওয়ায় বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংক এখন তারল্য সংকটেও ভুগছে। এদের মধ্যে অন্যতম ন্যাশনাল ব্যাংক। গত বছরে ব্যাংকটি ৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে খেলাপি ঋণে শীর্ষ রয়েছে এই ন্যাশনাল ব্যাংক। ফলে লোকসান ও খেলাপি ঋণে শীর্ষে উঠে এসেছে ব্যাংকটি। গত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা।
মালিকানা পরিবর্তনের পর ধারাবাহিকভাবে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বাড়ছে। তিন মাসের ব্যবধানে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৪০২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও একই সময়ে ১ হাজার ৬৩৯ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। শরিয়াহভিত্তিক শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯০৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১৩২ কোটি টাকা।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে (ইউসিবি) ২০২২ সালে ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা, যা গত মার্চে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বরে ট্রাস্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, গত মার্চে বেড়ে তা হয়েছে ২ হাজার ২৬ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫৮২ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৯৬ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকের ১ হাজার ৮২৯ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়ার খেলাপি ১ হাজার ১৯১ কোটি থেকে বেড়ে ১ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা হয়েছে। যমুনা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫১৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৬২ কোটি টাকা।
বেসরকারি সীমান্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩১ কোটি টাকা, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৪৩৫ কোটি থেকে ৬৭২ কোটি টাকা, এনআরবি ব্যাংকের ১৪৮ কোটি থেকে ৩০৬ কোটি টাকা ও মধুমতি ব্যাংকের ৯৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২১৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাসের শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা।
এছাড়া, বেসরকারি ব্যাংক ১১ লাখ ৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এরমধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৫৬ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩৬ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এরমধ্যে খেলাপি ৪ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলো এ সময়ে ৬২ হাজার ২৭ কোটি টাকা বিতরণ করে, তাদের খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪২ কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে—রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
ঋণের হিসাবে গত মার্চে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ অগ্রণী ব্যাংকে। দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকটির ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশই খেলাপি ঋণ। জনতা ব্যাংকের ১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশই খেলাপি ঋণ। সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। গত বছরের (২০২২) একই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। আর ৩ মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর হচ্ছে না, তারা শুধু নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।’ ব্যবসায়ীদের একের পর এক ছাড় দিলে খেলাপি কীভাবে কমবে, এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এখন খেলাপি কমাতে অ্যাকশনে যেতে হবে।’