গাজীপুরের হার-জিত: আওয়ামী লীগ কি কিছু শিখবে?

মোনায়েম সরকার

মোনায়েম সরকার
মোনায়েম সরকার। ফাইল ছবি

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল কি প্রত্যাশিত ছিল? আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপি অংশ না নেওয়া সত্ত্বেও গাজীপুরের মতো জায়গায় নৌকা মার্কা নিয়ে ভোটের মাঠ থেকে হেরে বিদায় নিতে হবে, এটা নিশ্চয়ই কারও ভাবনার মধ্যে ছিল না। আওয়ামী লীগের তো নয়ই। কারণ গাজীপুরকে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি বলে মনে করা হয়। পচা শামুকে পা কাটে বলে যে কথাটা চালু আছে গাজীপুরে তার প্রমাণ পাওয়া গেলো।

ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে হারিয়ে বহুল আলোচিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন সাধারণ এক গৃহবধূ জায়েদা খাতুন। ক্ষমতাসীন দলের সর্বাত্মক সমর্থন পেয়েও আজমত উল্লার মতো শক্তিশালী একজন প্রার্থী জায়েদা খাতুনের কাছে হেরে যাবেন, তা অনেকে ধারণাই করতে পারেননি। রাজনীতি তো দূরের কথা, কোনো দিন সভা-সমাবেশ কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানেও যাকে অংশ নিতে দেখা যায়নি- সেই গৃহবধূই ইতিহাস সৃষ্টি করে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পনগরীর মেয়র নির্বাচিত হয়ে এখন দেশের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছেন।

নিজের গুণে নয়, ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের প্রক্সি প্রার্থী হয়ে এমন জয় পেয়ে জায়েদা খাতুন যে চমক সৃষ্টি করলেন তা আমাদের দেশের রাজনীতির জন্য কোনো শুভ বার্তা বয়ে আনলো কি? একটি সিটি করপোরেশনের মেয়র হতে গেলে যেসব অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন তার একটিও না থাকা সত্ত্বেও তাকে যারা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলেন, তারা খুব বিবেচনাবোধের পরিচয় দিয়েছেন কি? বলা হচ্ছে, এই জয়ের পেছনে সাবেক মেয়র এবং আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীর আলমের ভোট কৌশলকেই প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। কেউ কেউ জায়েদা খাতুনের এই সাফল্যকে ‘জাহাঙ্গীর ম্যাজিক’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন।

জাহাঙ্গীর আলম কে? গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হন। একই সময় আওয়ামী লীগ থেকেও তাকে বহিষ্কার করা হয়। চলতি বছরই সাধারণ ক্ষমায় আবার দলে ফেরেন। কিন্তু মেয়র পদে নৌকার মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হলে আবার আজীবনের জন্য বহিষ্কার হন আওয়ামী লীগ থেকে। ঋণখেলাপির কারণে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়। ভোট করতে পারবেন না- এই আশঙ্কায় মা জায়েদা খাতুনকেও প্রার্থী করেন জাহাঙ্গীর। পুরো নির্বাচনী প্রচারে ছেলের ছায়া হয়েছিলেন জায়েদা।

মা কাগজ-কলমে প্রার্থী হলেও বাস্তবে ভোটে লড়েছেন ছেলে। ফলে তার জয় আদতে জাহাঙ্গীরের বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। আর এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভোটের রাজনীতিতে চৌকস খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করলেন জাহাঙ্গীর। অবশ্য জায়েদার এই বিজয়ের পেছনে জাহাঙ্গীরের ভোটচাল ছাড়া আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বিএনপি-জামায়াতের ভোট, নারী ভোট, সহানুভূতি এবং মেয়র থাকাকালে নগরীর উন্নয়নে জাহাঙ্গীরের আন্তরিক প্রয়াস অন্যতম।

জায়েদার এই জয়ের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি কাজ করেছে, তা হলো, বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন ও গোষ্ঠীর নীরব সমর্থন। ভোটবর্জনের কারণে দলীয় কোনো প্রার্থী না থাকায় বিএনপি-জামায়াতের একচেটিয়া ভোট পড়েছে টেবিল ঘড়ি মার্কায়।

আওয়ামী লীগের বড় ত্রুটি ছিল প্রার্থী হিসেবে জায়েদাকে গুরুত্ব না দেওয়া। এই নির্বাচনে নগরীর বেশির ভাগ কেন্দ্রেই টেবিল ঘড়ির পোস্টার ও এজেন্টদের দেখা না মিললেও নৌকার সরব উপস্থিতি এবং কোথাও কোথাও ভোট চলাকালীন কেন্দ্রের সামনে আজমত উল্লার সমর্থকদের মিছিলও করতে দেখা গেছে। কিন্তু ভোটের ফলাফলে মেলে ভিন্ন চিত্র। দলের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে জাহাঙ্গীরকে আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুর মহানগরে রাজনীতি করা এবং মেয়রের পদে থাকায় রাজনীতির বাইরেও জাহাঙ্গীরের আলাদা একটা বলয় তৈরি হয়।

এছাড়া তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্থানীয় কাউন্সিলর প্রার্থী, ৫৭টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে নির্বাচনী মাঠে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। দল থেকে বহিষ্কারের ভয়ে অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে থাকলেও ভোটের মাঠে কাজ করেছেন টেবিল ঘড়ির জন্য। অনেকেই নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে ভোট চেয়েছেন জায়েদা খাতুনের টেবিল ঘড়ির জন্য। নিরাপত্তার কারণে বাইরে বাইরে নৌকার পক্ষে থাকার ভান করে ভেতরে ভেতরে তারা টেবিল ঘড়ির জন্যই ভোট চেয়েছেন। বুকে নৌকা ব্যাজ লাগিয়ে এরকম করার কারণ হিসেবে কেউ কেউ সাংবাদিকদের বলেছেন, আজমত উল্লার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আর আমাদের বিপদে-আপদে সব বিষয়ে আমরা জাহাঙ্গীর আলমকে কাছে পাই, তার সহযোগিতা পাই।

তাছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন স্থানীয়ভাবেই সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। এখানে জাতীয় নির্বাচনের কোনো আঁচ নেই। ফলে এখানে যে আমাদের উন্নয়নে কাজ করবে, আমরা তাকেই বেছে নেব, এটাই স্বাভাবিক। গণমাধ্যমে এমন খবরও ছাপা হয়েছে যে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতার হাত আছে জাহাঙ্গীরের মাথার ওপর। এর বাইরে এবারের নির্বাচনে স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা একজন মন্ত্রীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। মন্ত্রীর কেন্দ্রেও নৌকা টেবিল ঘড়ির কাছে হেরেছে।

২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর ১০ বছর পার হয়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন কিংবা সিটি করপোরেশনের তেমন কোনো সুবিধা পাননি নগরীর বাসিন্দারা। এর মধ্যেও প্রশস্ত মূল সড়ক ও অলিগলির প্রায় ৯০ ভাগ রাস্তাঘাটসহ যতটুকু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে তা এই জাহাঙ্গীর আলমই করে দিয়েছেন বলে স্থানীয়রা মনে করেন।

এছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে তার রয়েছে নিবিড় সম্পৃক্ততা। জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে স্কুল থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত বৃত্তি দেয়া, সিটির ৫৭টি ওয়ার্ডেই তার এই শিক্ষা ফাউন্ডেশনের শক্তিশালী কমিটি রয়েছে। দীর্ঘদিন এই কমিটির আওতায় উজ্জীবিত করেছেন স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটির ছাত্রদের। এর মাধ্যমে এসব ছাত্র-ছাত্রীর পরিবারের সদস্যদের কাছে টানার চেষ্টা করেছেন। নগরীর সব মসজিদের ইমামদের নিয়ে ইমাম সমিতি করেছেন। সেখানে প্রতি মসজিদের ইমামদের মাসে ৪০০০ করে বছরে ৪৮ হাজার টাকার এককালীন চেক তাদের হাতে তুলে দিতেন। এই ইমামদের পরিবারের কয়েক হাজার সদস্য তার ভক্ত। অনেক অসহায় ও বেকার পরিবারের সদস্যদের চাকরির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এছাড়া সব দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সুসম্পর্ক রাখেন এবং তাদের বিপদে-আপদে পাশে থাকেন।

রাজনীতি সচেতন স্থানীয় অনেকেই এটা মনে করেন যে গাজীপুরে দলীয় নেতা কিংবা ব্যক্তি হিসেবেও আজমত উল্লা খানের চেয়ে জাহাঙ্গীর আলমের ভোট বেশি। গত কয়েকটি নির্বাচনে এটি বোঝা যায়। বিশেষ করে গাজীপুরে মোট ভোটারের প্রায় ৪০ শতাংশ হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ভাসমান ভোটার। গাজীপুর শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এবং জাহাঙ্গীর আলম নিজেও একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী বলে এই ভাসমান ভোটারদের (পোশাক শ্রমিক) অধিকাংশই তাকে ভোট দেন। এটি গাজীপুরের একটি বিরাট ভোটব্যাংক।

২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি নির্বাচনেও যখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন, সেখানেও জাহাঙ্গীর আলম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। ওই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন এবং ভোটের দিনের বেশ কয়েকদিন আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পরও প্রায় ৩০ হাজার ভোট পান। তার মানে ভোটের মাঠে থাকলে হয়তো তিনি ওই নির্বাচনেও জয়ী হতেন। এরপর ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকারকে বিপুল ভোটে হারিয়ে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হন।

এই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর এবং তার মা সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পেয়েছেন। জাহাঙ্গীর আগেরবার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার তিন বছরের মাথায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। জাহাঙ্গীরের অভিযোগ ছিল- বিনা কারণে তাকে ষড়যন্ত্র করে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ওপর অবিচার ও অন্যায় করা হয়েছে বলে তিনি ভোটারদের কাছে প্রচার করে ব্যালটের মাধ্যমে এই অন্যায়ের বিচার দাবি করেন। একজন নির্বাচিত মেয়রকে বড় কোনো কারণ ছাড়া চেয়ার থেকে সরিয়ে দেওয়া কেউ কেউ সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। এছাড়া জায়েদা খাতুন নারী হওয়ায় হয়তো নারী ভোটারদেরও বাড়তি সহানুভূতি পেয়েছেন।

আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লা মার্জিত, বিনয়ী ও স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ হিসেবে গাজীপুরের রাজনীতিতে পরিচিত হলেও তার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দলের তৃণমূলের নবীন কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগের ঘাটতি রয়েছে। সেটি বয়সের কারণে হোক কিংবা তার ব্যক্তিগত অন্য কোনো কারণেই হোক। দীর্ঘদিন রাজনীতি করলেও সাধারণ মানুষের কাছে হতে পারেননি আস্থার প্রতীক।

এছাড়া নির্বাচনের প্রচারেও ছিল গাফিলতি। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে ঢিলেমি ছিল প্রচারণায়। বড় বড় শোডাউন এবং রোড শো করলেও মানুষের দ্বারে দ্বারে যাননি। এর ঠিক উল্টোপথে হেঁটেছিলেন জায়েদা খাতুন। ছেলে জাহাঙ্গীর আলমকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। বড় সভা-সমাবেশ এড়িয়ে ভোটারদের কাছে পৌঁছেছিলেন জায়েদা খাতুন।

গাজীপুরে ভোটের ফলাফল আওয়ামী লীগের জন্য বড় ধাক্কা। স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি, অভ্যন্তীরণ দ্বন্দ্ব, জনগণের মনোভাব ইত্যাদি সম্পর্কে দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে যে সঠিক তথ্য নেই, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। গাজীপুরে একজন নবাগতার কাছে নৌকার পরাজয় সারাদেশে এই বার্তাই দিচ্ছে যে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সমর্থন আগের মতো নেই। জুন মাসে যে চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে সেগুলোতেও গাজীপুরের প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। কয়েক মাস পরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের জন্য সতর্ক হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।

আওয়ামী লীগকে উন্নয়ন গর্বে আত্মমগ্ন থাকলে চলবে না। দলের মধ্যে বিভেদ, একশ্রেণির নেতাকর্মীর ঔদ্ধত্য, বাড়াবাড়ি আচরণের জন্য ভেতরে ভেতরে যেসব শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ করার ক্ষেত্রে আলসেমি করলে ফল কেমন হবে তা গাজীপুরই জানিয়ে দিচ্ছে না কি?

লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর

শেয়ার করুন