শতবর্ষ পূরণ করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। গত শনিবার (২৭মে) তিনি ১০১ বছরে পা রাখেন। বিশ্বের জীবিত কূটনীতিবিদদের মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে আলোচিত হেনরি কিসিঞ্জার। শতবছরে এসেও কার্যকর সাবেক কূটনীতিবিদ। এখনও মার্কিন কর্তাব্যক্তিরা তার পরামর্শ গ্রহণ করেন।
কিসিঞ্জার ১৯২৩ সালের ২৭ মে জার্মানির একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার নাৎসি শাসন আমলে জার্মানি থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যায়। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা।
হার্ভার্ড থেকে পিএইচডি করা রাজনৈতিক তাত্ত্বিক কিসিঞ্জার মূলত পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন ১৯৬৯-৭৬ সালে, যে সময়টায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের মূল খেলোয়াড় ছিলেন।
১০০ বছরে এসেও মানুষের কাছে তিনি কখনও প্রশংসিত হয়েছেন; আবার হয়েছেন নিন্দিতও। কূটনৈতিক বুদ্ধির জন্য যেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, ঠিক তেমনই নিন্দারও পাত্র হয়েছেন তার প্রণঘাতী নিপিড়নমূলক কৃতকর্মের জন্য। কখনও মানুষ তাকে আখ্যা দিয়েছে বুদ্ধিমান হিসেবে। আবার কখনও ‘শয়তান’, ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে।
কিসিঞ্জার আমেরিকার সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কূটনীতিক। তার বিশষত্ব হচ্ছে তিনি সব সময় অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতের চিন্তা বেশি করতেন। সমর্থকদের জন্য কিসিঞ্জার একজন প্রতিভাবান কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব; যার রাজনৈতিক অর্জন অন্য কারো সমতুল্য নয়। সমালোচকদের কাছে তিনি একজন যুদ্ধাপরাধী। তবে তিনি রাজনৈতিক ও মিডিয়াতে সবসময় প্রশংসিত হয়েছেন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেশ কয়েকটি রক্তাক্ত সংঘর্ষের পেছনে তার হাত রয়েছে বলে মত ইতিহাসবিদদের। ভিয়েতনাম যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করা, সেটাকে কম্বোডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে বিতর্কিত অবস্থান নেয়াসহ বিভিন্ন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পেছনে তার মস্তিষ্ক কাজ করেছে।
কেবল তাই নয়, স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন দাঁতাত, চীন-মার্কিন সম্পোর্কোন্নয়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাকে উৎখাত করা, বেশ কয়েকটি দেশের সীমানা পুনর্নির্মাণ করা- কোন খাতে তার অবদান নেই তাই বলা মুশকিল।
হেনরি কিসিঞ্জার গত শতকের সত্তরের দশকজুড়ে অত্যন্ত কদর্যভাবে বিপুলসংখ্যক গোপনীয় কাজ করেছেন। তিনি লাওস ও কম্বোডিয়ায় অবৈধ বোমা হামলার ছক কষেন এবং তার বাস্তবায়নও করেন। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং প্রতিবেশী লাওসে তিনি যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন, তার কারণে কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বলা হয়, পূর্ব তিমুর ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (আজকের বাংলাদেশ) গণহত্যার পথ সুগম করেন কিসিঞ্জার।
ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধতেও বেশ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। কিসিঞ্জার নভেম্বরে আলোচনার মাধ্যমে শান্তির আহ্বান জানিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করেন। তার আবেদন এমন সময়ে এসছিল, যখন ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা কিয়েভকে তাদের সামরিক সহায়তা বাড়িয়েছিল।
সে সময় কিসিঞ্জার যুক্তি দিয়েছিলেন, আরেকটি বিধ্বংসী বিশ্বযুদ্ধ এড়াতে আসন্ন আলোচনার প্রয়োজন ছিল। তবে এতে কিয়েভ তাকে ‘রাশিয়াকে সন্তুষ্ট করার’ অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন। তিনি ইউক্রেনের ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে যেভাবে সমর্থন করেছেন তাতে তার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানের বিষয়টি আর টিকে থাকে না।
কিসিঞ্জার যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনকে হেয় করেছেন। আন্দোলনকারীদের ‘উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির কলেজপড়ুয়া বাচ্চা’ বিশেষণ ব্যবহার করে তাদের অপমান করেন তিনি। নারীদেরও অপমান করেন তিনি। তার ভাষায়, ‘আমার কাছে নারী বিনোদনের বেশি কিছু নয়, একটা শখমাত্র। আর কেউ শখের পেছনে খুব বেশি সময় ব্যয় করে না।’
চিলির সামরিক অভ্যুত্থান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, পূর্ব তিমুর ও কম্বোডিয়ার বোমা হামলায় হেনরি কিসিঞ্জারের বিতর্কিত সম্পৃক্ততা এখনও বিশ্বরাজনীতিতে তাকে নিন্দিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করে।
কেবল তাই নয়, হেনরি কিসিঞ্জার এখনো প্রাসঙ্গিক। তিনি প্রায় সময়ই আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে জনসাধারণকে সতর্ক করেছেন। এআই-এর ক্ষতিকে তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষতির সঙ্গে তুলনা করেছেন।