বিভ্রান্তি সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
ফাইল ছবি

মার্কিন সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে নতুন ভিসানীতি প্রণয়নের পরই বিভিন্ন লোক এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়েছেন। ঠিক তখনই কিছু সমাজসচেতন মানুষ আমাকে অনুরোধ করলেন এ ব্যাপারে মূলত আইনি দিক উল্লেখ করে লেখার জন্য, যে কারণে আমার লেখাটি একটু ভিন্ন ধরনের। তাঁদের অনুরোধের কারণ এই যে আমার জীবনের এক যুগের বেশি সময় কেটেছে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন, তত্সংক্রান্ত আইন ও পদ্ধতি নিয়ে কাজ করে। তখন আমি যুক্তরাজ্য ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজারি সার্ভিসে কর্মরত ছিলাম।

সে সময়ে পদাধিকার বলে আমার দায়িত্ব ছিল ব্রিটিশ ভিসা, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের, পুলিশ ও ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভিসা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে ভাষণ প্রদান করা। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের দেশে ইমিগ্রেশন আপিল পদ্ধতি প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে শিক্ষা নেওয়ার জন্য যেসব কর্মকর্তাকে যুক্তরাজ্যে প্রেরণ করত, তাঁদের প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব যে কজনের ওপর বর্তাতো, আমি ছিলাম তাঁদের একজন।

অনেকেরই প্রশ্ন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের আইনি ক্ষমতা নিয়ে। আমাদের মতো যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সে দেশের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা কংগ্রেসের ওপর।

কংগ্রেসও এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিয়ন্ত্রণ আইন দ্বারা পরিচালিত, যা প্রণয়নের ক্ষমতা সে দেশের কংগ্রেসের।
বাংলাদেশসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রেও রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন রয়েছে। অনেকে প্রশ্ন করছেন নির্বাহী বিভাগের ভিসানীতি প্রণয়নের বৈধতা সম্পর্কে।

আমাদের মতো অধ্যাদেশ তৈরির বা যুক্তরাজ্যের রানির মতো (বস্তুত মন্ত্রিপরিষদের) প্রেরোগেটিভ ক্ষমতা মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধানের নেই। তবে বিভিন্নভাবে সীমিত পরিসরে আইন প্রণয়ন ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। যার একটি আসে কংগ্রেস প্রদত্ত ক্ষমতাবলে অর্থাৎ ডেলিগেটেড পাওয়ার দ্বারা। কংগ্রেস মার্কিন প্রশাসনকে অভিবাসনসংক্রান্ত আইন ও রেগুলেশন নিয়ন্ত্রণ করার সুবিধার জন্য সেখানকার ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটিকে বেশ কিছু ক্ষমতা প্রদান করেছে। তা ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সময়ে ঊর্ধ্বতন আদালতের রুলিং।

তবে আইন প্রণয়ন ক্ষমতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তত্ত্বটির নাম ডেফারড অ্যাকশন, যেটি মার্কিন উচ্চ আদালতগুলোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়ে সত্তরের দশক থেকে, বিশেষ করে অভিবাসন ও ভিসা নিয়ন্ত্রণ ক্ষেত্রে প্রচলিত রয়েছে। আর এই ডেফারড অ্যাকশনতত্ত্ব বলেই কংগ্রেস ছাড়া মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের ব্যাপারে ভিসানীতি প্রণয়ন করতে পেরেছে। অতীতে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের অভিবাসন, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্ছেদের জন্য এ তত্ত্ব বলে প্রদেয় ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়েছে, যে ব্যাপারে ২০১১ সালে ডেভিড লিওপার্ড বিস্তারিত লিখেছেন, যার শিরোনাম ছিল ‘What legal authority President has to act on immigration?’ সুতরাং মার্কিন প্রশাসনের সিদ্ধান্ত আইনবহির্ভূত নয়।

ভিসা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বহুজন বহু কথা লিখছেন, অনেকের লেখায়ই প্রতিফলিত হচ্ছে ‘আপন মনের মাধুরী’। বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা বলার চেষ্টা করছেন, সরকারকে শায়েস্তা করার জন্যই এই নীতি। সে দাবির পেছনে কোনো ভিত্তি বা যুক্তি নেই। নীতিমালায় তেমন কোনো অস্পষ্টতা দেখা যায় না। বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যাঁরা বাধা সৃষ্টি করবেন, তাঁদের ভিসা প্রদান করা হবে না। তাঁরা ব্যক্তিবিশেষ হতে পারেন, হতে পারেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিচারক প্রমুখ। সম্প্রতি বাংলাদেশের তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতারা ঢাকায় কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় বসেছিলেন বিষয়টি আরো পরিষ্কার করার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে অবাধ রাখার জন্যই এই নীতি। সোজা কথায় ভিসার বেড়াজালে তাঁরাই পড়বেন, যাঁরা বিভিন্নভাবে অবাধ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকবেন। সে অর্থে বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলের নেতা ও সদস্যদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা, কেননা তাঁরা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াচ্ছেন বর্তমান অবস্থায় তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না এবং তাঁদের সেই দাবি বাস্তবায়িত করার জন্য বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন, যা আসলে নির্বাচন বিরোধিতারই শামিল। তাঁরা রাস্তাঘাটে মিছিলের নামে জনজীবনে শুধু দুর্ভোগই সৃষ্টি করছেন না, বরং আগের মতোই জ্বালাও-পোড়াও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। শান্তি রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের দৈহিক ক্ষতিসাধন করছেন। তাঁরা এসব করছেন নির্বাচন প্রতিহত করে অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার মানসে। এ বিষয়ে সুচিন্তা ফাউন্ডেশন নামের গবেষণা সংস্থার প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাত, যিনি আওয়ামী লীগেরও একজন কেন্দ্রীয় নেতা, তিনি অন্যদের সঙ্গে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি বেশ কিছু প্রামাণ্য চিত্র মার্কিন সরকারের কাছে পাঠিয়েছেন বলে প্রকাশ। বিএনপি ছাড়া কিছু ছোট রাজনৈতিক দলের নেতা-সদস্যরাও নির্বাচন রুদ্ধ করার জন্য একই ধরনের নৈরাজ্য ও নাশকতা সৃষ্টি করছেন বিধায় মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার তীর তাঁদের দিকেই।

অনেকে বলার চেষ্টা করছেন পুলিশ, র‌্যাব বাহিনীও ভিসা জটিলতায় পড়তে পারে। তাঁদের এই যুক্তি উদ্ভট। পুলিশ শান্তি রক্ষার জন্য যা করছে, তা সুষ্ঠু নির্বাচনপ্রক্রিয়ার পথ প্রশস্ত করার জন্যই। তাই তারা যুক্তরাষ্ট্র তথা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাকেই প্রতিষ্ঠিত করার কাজে লিপ্ত। যাঁরা বলার চেষ্টা করছেন মার্কিন এই নীতির ফলে ক্ষমতাসীন দলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন যে ক্ষমতাসীন দল, বিশেষ করে দলের প্রধান প্রকাশ্যেই সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে জোরালো ভাষায় কথা বলছেন। সম্প্রতি গাজীপুরের নির্বাচনী ফল থেকে এটা পরিষ্কার যে বর্তমান সরকার অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনে বদ্ধপরিকর, আর সেই দায়িত্ব পালন করছে নির্বাচন কমিশন। যাঁরা ভ্রান্ত ধারণার প্রচার করছেন, তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। তাই জনগণকে মার্কিন নীতি পরিষ্কারভাবে বোঝানো সব সচেতন মানুষের দায়িত্ব।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

শেয়ার করুন