কী কথা তাহার সাথে!

মহসীন হাবিব

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে শোরগোলের মধ্যেই খানিকটা নীরবেই দুই দিনের সফর শেষ করেছেন চীনের ভাইস মিনিস্টার সান ওয়েইদং। জাতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল চীনের পররাষ্ট্র বিষয়ক ভাইস মিনিস্টারের সফরটি, যদি আমরা জাতির অদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকাই। কারণ প্রচারমাধ্যম এবং জনগণের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে যতই হৈ চৈ হোক, এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা। নির্বাচন নাই, যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতির কার্যকরণও নাই। দ্বিতীয়ত, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা মাত্র গুটি কয়েক মানুষের, যাদের হয়তো অর্থ আছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে অথবা বাড়ি-সম্পদ আছে দেশটিতে তাদের। সাধারণ মানুষের এতে কী আসে যায়! কিন্তু চীনের সফর করে যাওয়া এই উচ্চ কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা জাতির জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আলোচনায় যদি ফাঁক ফোকর থাকে, তাহলে দীর্ঘস্থায়ী একটি ক্ষত এসে পড়তে পারে বাংলাদেশের গায়ে, যার ভুক্তভোগী হবে এদেশের আপামর জনসাধারণ। পড়তে পারে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। আবার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই ঝানু চৈনিক কূটনীতিকের সঙ্গে বার্গেইনিং করা গেলে হয়তো লাভও হতে পারে। সেটা সরকার বুঝবে।

ঢাকায় এসে ২৭ ও ২৮ মে বেশ ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন সান ওয়েইদং। দীর্ঘ প্রায় ৪ ঘন্টা সময় ধরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৈঠক করেছেন। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এবং সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তিনি পদ্মা সেতু ও পদ্মা রেল প্রকল্পও পরিদর্শন করেছেন।

universel cardiac hospital

কূটনীতির একটি বিষয় আমরা এই বয়সে এসে বুঝতে পারি, যেটা তরুণ বয়সে বোঝা মুশকিল। কূটনীতির প্রকাশ্য ভাষা, অঙ্গভঙ্গি থাকে এক রকম, আর অন্দমহলে বা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে থাকে আরেক রকম। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের একজন উচ্চ স্তরের কর্মকর্তার সঙ্গে যখন শক্তিশালী কোনো দেশের কূটনীতিক বা প্রতিনিধি বসে কথা বলেন, তখন ছবি দেখে এবং সরবরাহ করা সংবাদ দেখে মনে হয়, ওই কূটনীতিক খুব বিনয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং উন্নয়নশীল দেশটির জন্য একটি সাহায্যের ডালা নিয়ে এসেছেন। দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের ওই উচ্চপদস্থ ব্যক্তি পায়ের উপর পা দিয়ে বসে আছেন, কিন্তু তারই সামনে বিড়ালের মতো বিনয়ী কূটনীতিক বসে আছেন। বিষয় আসলে তা না। প্রকৃত চেহারা উল্টো। ওই বিনয়ী কূটনীতিক শর্ত চাপিয়ে দিয়ে, অঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে বিনয়ের সঙ্গে হুমকি দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে রাখা উন্নয়নশীল বিশ্বের ব্যক্তিকে ঘামিয়ে ফেলেন। এ ছাড়াও তারা বাইরে এসে যা বলেন, তার সঙ্গে ভেতরের আলোচনায় থাকে অনেক তফাৎ। সেসব ২০ বা ৩০ বছর পরে কোনো অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক বা রাজনীতিবিদের স্বীকারোক্তিমূলক আত্মজীবনী বা স্মৃতিচারণে পাওয়া যায়। কিন্তু ততদিনে যা ঘটার তা ঘটে গেছে।

কিন্তু তারপরও কিছু কিছু সংবাদ বের হয়ে যায়। কথায় বলে দেয়ালেরও কান আছে। তাছাড়া আধুনিক এই যুগে সবকিছু লুকিয়ে রাখা যেমন দুস্কর, তেমনি আধুনিক মানুষ অনেক অ্যাডভান্স ভাবতে পারে। এই যেমন চীনের ভাইস মিনিস্টারের সঙ্গে বৈঠকে উপরিতলে (সারফেসে) আলোচনা হয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে। গ্লোবার ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ নিয়েও কথা হয়েছে। এসব সংবাদ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, চীনের এই নেতা বুঝি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও এ বিষয়ক সমস্যাকেই জোর দিয়েছেন। কিন্তু শোনা যায়, চীনের ভাইস মিনিস্টারের সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ বা জিডিআইতে অন্তর্ভূক্তির জন্য চাপ দেওয়া বা পীড়াপীড়ি করা। এ বিষয়ে এটি দ্বাদশতম প্রচেষ্টা।

বলে রাখা ভালো, চীনের ভাইস মিনিস্টার সান ওয়েইদং বা সুন ওয়েই দং এই অঞ্চল বিষয়ক একজন এক্সপার্ট। তিনি ভারতে এবং পাকিস্তানে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি পাকিস্তানের যথেষ্ট মন জয় করেছেন। সুন ওয়েইদংকে পাকিস্তান সরকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক ‘হিলালি পাকিস্তান’ খেতাবে ভূষিত করেছে। যে কোনো দেশের যে কোনো ব্যক্তি পেশাগত দায়িত্বে থেকে অথবা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় যদি পাকিস্তানে বিশেষ অবদান রাখেন তাকেই কেবল এই খেতাব দেওয়া হয়। বলতে চাচ্ছি, তিনি কিন্তু পাকিস্তানের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। পাকিস্তানও তার ভক্ত। তা হোক, যে কোনো মানুষের যে কোনো দেশের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা থাকতেই পারে। আমি শুধু ইনফরমেশনটা দিয়ে রাখলাম।

এখন প্রশ্ন হলো, চীনের এই গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনেশিয়েটিভ বা জিডিআই কী এবং কেন? ২০২২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে চীনের পররাস্ট্রমন্ত্রী গ্লোবাল ডেভেলপমন্টে ইনেশিয়েটিভ উপস্থাপন করেন। সেখানে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট শি জিং পিঙের নেওয়া নতুন এই উদ্যোগ ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে। এর আওতায় আছে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, কোভিড মোকাবেলা, জলবায়ু পরিবর্তন, ডিজিটাল ইকোনোমি, কানেকটিভিটি। ২০১৩ সালে শি জিং পিঙের নেওয়া চিনের গৃহীত বিআরআই এর সঙ্গে এই উদ্যোগের বৈশিষ্ট্যগত কিছু পার্থক্য আছে। বিআরআই হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভিত্তিক, আর জিডিআই হলো উন্নয়ন ভিত্তিক। সে উন্নয়ন সামাজিক, সংস্কৃতিক থেকে শুরু করে সফটওয়্যার, জ্ঞান বিনিময় এমনকি রাজনৈতিক মতবিনিময়ও হতে পারে। অর্থাৎ সহযোগিতার কোনো সীমারেখা নেই। বিআরআই সাধারণত দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক এবং সেক্ষেত্রে অংশীদার দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর হয়ে থাকে। কিন্তু জিডিআই বহুমুখী। হতে পারে এনজিও অথবা প্রাইভেট সেক্টর, এমনকি ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমেও। অর্থাৎ চীনের এই উদ্যোগ অধিক বিস্তৃত। তারা কমপক্ষে ৫০ টি দেশের সঙ্গে এই জিডিআই পার্টনারশিপে যেতে চাচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, চীন উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই জিডিআই এর মাধ্যমে তাবু গাড়তে চেষ্টা করছে।

এখন কথা হলো, বাংলাদেশ চিনের এই নতুন উদ্যোগের সঙ্গে থাকবে কি না। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশকে চীন এ বিষয়ে সমঝোতা স্বাক্ষরের জন্য চূড়ান্ত খসড়া পাঠিয়েছে এবং বাংলাদেশের সম্মতির নিশ্চয়তার জন্য বারবার তাগিদ দিচ্ছে। বাংলাদেশও নাকি সেই খসড়ার সঙ্গে নতুন কিছু শর্ত যোগ করতে বেইজিং এর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।

কী করবে তা সরকার জানে। নিশ্চয়ই দেশের ভালো হয় এমন কথাই সরকার প্রধান ভাববেন। তবে সাধারণ জ্ঞানে সাধারণ দুটি কথা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। একটা হলো, সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে, বাংলাদেশের মতো দুর্বল অর্থনীতির একটি দেশ যাতে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি এবং চীনের জিডিআই’র মধ্যখানে পড়ে হাবুডুবু না খায়। দ্বিতীয়টি হলো, সামনে দেশে নির্বাচন। এই নির্বাচনটি পার করে পরবর্তী সরকার পাঁচ বছর দেশ চালাবে। তাড়াহুড়ো না করে বিষয়টি সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায় কি না, অর্থাৎ পরবর্তী সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় কি না। আরো একটি বিষয় লক্ষ রাখা দরকার। তা হলো, যে কোনো অবস্থাতেই যেন জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন না হয়।

সবকিছু আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। কিন্তু কখনো কখনো খটকাও তো লাগে! এই যেমন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতে চীনের ভাইস মিনিস্টার উল্লেখ করেছেন, যে ঐতিহ্যগত বন্ধুত্ব পূর্ববর্তী জেনারেশন গড়ে রেখে গেছে তাকে চীন সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। ভালো কথা। কিন্তু পূর্বের দিকে তাকালে যে কষ্ট হয়! বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত চীনের কাছ থেকে জাতি হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি। চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বটা গড়ে উঠেছিল জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। এবং বহুকাল ধরে চীন অন্ধভাবে বিএনপির রাজনীতিকে সমর্থন দিয়ে গেছে। এমনকি একমাত্র দেশ চীন, যারা বেগম খালেদা জিয়ার ১৫ আগস্টের মিথ্যা জন্মদিনে ফুলের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। তাই দইয়ের বদলে যেন চুন খেতে না হয় সেদিকে সরকার নজর রাখবে বলেই আশা করি।

লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

শেয়ার করুন