২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য জাতীয় সংসদে সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। বৃহস্পতিবার (১ জুন) বিকালে পেশ করা এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রেখে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন। আর প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। যা গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। এই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাকে উচ্চাভিলাসী বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা এবং রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তাকে উচ্চাভিলাসী মন্তব্য করে তা অর্জন অতটা সহজ হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, সরকার মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার বিষয়টিকে বাজেটে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, এটা ইতিবাচক। তবে অনেক কিছুই নির্ভর করছে ইউক্রেইন যুদ্ধ থামবে কি না, তার ওপর। এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী ওই লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন, যখন ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে চলতি অর্থবছরের দশ মাসেই গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশের কাছাকাছি উঠে গেছে।
যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচককে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে তা সংশোধন করে ৬ শতাংশ করা হয়। তবে সেই লক্ষ্যও পূরণ করা যায়নি।
বিশ্লেষকদের কেউ বলছেন, উচ্চাশা থাকা ভালো, কারণ আশাবাদী হলেই ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার কেউ বলেছেন, অতি আশাবাদের বদলে বাস্তবতা ও ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্য ধরাই উচিত ছিল সরকারের।
এদিকে বিরাজমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ‘পূরণ হবে না’ মন্তব্য করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘দেশের অর্থনীতি নানামুখী চাপের মধ্যে, এমন সময় নতুন অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য উচ্চাভিলাষী।
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির চাপ, বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে, আমদানি কমে যাচ্ছে। এই পরিবেশে প্রবৃদ্ধি খুব একটা যে হবে সেটা আশা করা ঠিক না। এ বছর বলা হচ্ছে ৬ দশমিক ০৩। সেটাও কমে হয়ত ৫ এর ঘরে চলে আসবে। আগামী বছর যে খুব একটা ব্যতিক্রম কিছু হবে তা মনে হয় না।’
একই কথা বললেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য যে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেটি বাস্তবসম্মত নয়। এটি অর্জন কঠিন হবে। তবে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। জিডিপির অনুপাতে কর আহরণ বিশ্বের সর্বনিম্ন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ। পার্শ্ববর্তী নেপালের চেয়েও কম আদায় হয়।
বাজেট প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘কোভিড মহামারির সময়টা বাদ দিলে গত ১২ বছরের মধ্যে এই প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির ভিত্তি কমে এসেছে। কিন্তু নতুন বাজেটে প্রবৃদ্ধির যে টার্গেট ধরা হচ্ছে, সেটা কিছুটা অনুমান নির্ভর, কিছুটা আইএমএফ এর শর্তের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন যে অবস্থায় রয়েছে, এটা আসলেই একটা আশঙ্কাজনক জায়গায় চলে এসেছে। সেটা পর্যাপ্তভাবে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।’
এখন রিজার্ভ বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দিয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক বলেন, ‘বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন মাসের আমদানি বিল মেটানোর মতো অবস্থায় আছে। এর ফলে আগামী বছর থেকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কষ্টকর হবে। এমন এক নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরেক দফা কমে গেলে আমদানি ব্যয় আরও বেড়ে যাবে।’
অবশ্য সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন সরকারের আশাবাদে দোষের কিছু দেখছেন না। তার ভাষ্য, উন্নয়নের একটা অংশই হল আশাবাদী হওয়া।
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, ইউক্রেইন যুদ্ধ আর বেশি দিন ধরে চলতে পারবে না। এই রকম একটা আশাবাদ থেকে সরকার এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। এটা ঠিকই আছে। আমি মনে করি ইউক্রেইন যুদ্ধ আর প্রলম্বিত হতে পারে পারবে না নানান কারণে। এখানে উন্নত দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’
এদিকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ চ্যালেঞ্জ হতে পারে মন্তব্য করে বাজেট পরবর্তী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেছেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ২০৪১ সাল এবং এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশের থেকে উত্তরণ) গ্র্যাজুয়েশনকে মাথায় রেখে বাজেট ঘোষণা করেছেন। সেখানে চ্যালেঞ্জ অবশ্যই আছে, কালেকশনটা (রাজস্ব আহরণ) চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক বাজেট প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
মহামারীর ধাক্কা সামলে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেয়েছিল বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
কিন্তু ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে পুরো বিশ্ব অর্থনীতিই চাপের মধ্যে রয়েছে। বৈরী পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয় এবারের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সংশোধন করে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়েছিল। কিন্তু সেই লক্ষ্যেও পৌঁছানো যাচ্ছে না।
মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের হিসাব ধরে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, তাতে দেখা যাচ্ছে, সাময়িক হিসাবে স্থির মূল্যে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হতে পারে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই দেশের বাজারে ছিল ভোক্তাদের হাহাকার। একক মাসের হিসাবে এক যুগের রেকর্ড ভেঙেছে মূল্যস্ফীতির পারদ। গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের দশ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।