মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ আসতে আরও কিছুদিন বাকি। প্রাক্-বর্ষার এই সময়ে দেশের সব অঞ্চলেই বয়ে চলছে অসহনীয় তাপপ্রবাহ। এই তাপপ্রবাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমগ্র দেশজুড়ে বিপুল বিক্রমে হচ্ছে লোডশেডিং। আমি রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিতে থাকি, এখানেও প্রতিদিন নিয়ম করে তিন–চারবার লোডশেডিং হয়। ঢাকার বাইরে তথা গ্রামাঞ্চলে পরিস্থিতি এখন দুর্বিষহ পর্যায়ে। জনদুর্ভোগের ব্যাপকতা এতোটাই বেড়েছে যে, সরকারও তার ‘অস্বীকারের স্বভাব’ রক্ষা করতে পারছে না। ইতোমধ্যে সরকার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কারণ হিসেবে উপস্থাপন করে জ্বালানির অপ্রতুলতার অজুহাত দিয়ে দেশব্যাপী লোডশেডিং–এর কথা স্বীকার করে জনগণের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে। পরিস্থিতি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশ্বস্ত করেছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী।
কয়লা সংকটে আজ রোববার দিবাগত মধ্যরাত থেকে পুরোপুরি বন্ধ হতে যাচ্ছে দেশের বৃহত্তম ও সর্বাধুনিক পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হলে জাতীয় গ্রিডে অন্তত ১২শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। এতে দেশে দেখা দিতে পারে ভয়াবহ লোডশেডিং। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরে বাকিতে কয়লা এনে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সচল রাখা হয়েছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দেনা প্রায় ৩৬ কোটি ডলার। এই বকেয়া পরিশোধ না করলে নতুন করে কয়লা আনা সম্ভব হবে না। আমাদের প্রশ্ন হলো– বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় কেন এতো টাকা বকেয়া রাখলো? এটি নিঃসন্দেহে মন্ত্রণালয়টির ব্যর্থতার দিকটি-ই উন্মোচিত করেছে। বিশ্ববাজারে গ্যাস, জ্বালানি ও কয়লার মূল্য গতবারের তুলনায় অর্ধেকে হ্রাস পাওয়ার পরও কেন এখনও এগুলো আমদানি করা সম্ভব হয়নি? এই প্রশ্নের উত্তরও জনগণ জানতে চায়।
এতদ্ব্যতীত, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেল–গ্যাস, কয়লা আমদানি করতেই হবে আমাদের? আর কোনো বিকল্প ছিল না? অবশ্যই ছিল। সরকার নিজেদের গ্যাস উত্তোলনে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারতো। কিন্তু ঐ পথে না নিয়ে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি, কয়লা ও পারমাণবিক প্রকল্প গ্রহণের পথে এগিয়েছে। তারা শুধু পাওয়ার প্ল্যান্ট করে গেছে; কিন্তু পাওয়ার প্ল্যান্ট যে বিদ্যুৎ নয়, সেটি তারা অনুধাবন করতে পারেনি। বিদ্যুৎ উৎপাদনযন্ত্রের জন্য তো জ্বালানি জোগাতে হবে। কিন্তু সেই জ্বালানি কোথা থেকে আসবে সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না বলেই আজ আমরা এমন বিপদে পড়েছি। জ্বালানি সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় সক্ষমতার বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষা করে রেন্টাল, কুইক রেন্টালসহ এসব অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি রক্ষায় বারবার দায়মুক্তি আইনের মেয়াদ বাড়িয়েছে। এভাবে গৃহীত সব প্রকল্প দেশি কিছু গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির জন্য উচ্চ লাভজনক হলেও দেশের জন্য আর্থিকভাবে মহাবিপদ তৈরি করেছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির কিছু ভুল এবং কিছু মানুষকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নীতির কারণেই আজকে লোডশেডিংয়ের চরম পরিস্থিতি। একটি ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী মহলের কারণেই দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। একইসঙ্গে এই খাতটি দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের দিকে ক্রমান্বয়ে ধাবিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারপ্রধান তথা বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা-ই একমাত্র আস্থার জায়গা। আমাদের প্রত্যাশা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অসঙ্গতিসমূহ তিনি খতিয়ে দেখবেন এবং জ্বালানি সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, মত ও পথ।