বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে নিস্পিষ্ট অন্যান্য রাষ্ট্র ও জাতির ইতিহাস থেকে ভিন্নতার দাবি রাখে। প্রথমত, একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম; দ্বিতীয়ত, ভাষাগত দিক থেকে এক অভিন্ন ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সংগ্রাম; তৃতীয়ত, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট বহুজাতিক ভারতীয় জাতীয়তা ও ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তার বিপরীতে নৃতাত্ত্বিকভাবে একক জাতিসত্তার স্বতন্ত্র জাতীয়তার বিকাশ; এবং চতুর্থত, গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পথ ধরে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা অন্য উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতা অর্জনের পথ থেকে এক স্বতন্ত্র ও অনন্য ইতিহাস রচনা করেছে। শুধু এশিয়া নয়, সারাবিশ্বে উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতা অর্জনের পথ প্রায় অভিন্ন। হয় এসব দেশ সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিংবা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর দখলদারিত্ব ছেড়ে দিয়ে সাম্রাজ্য গুটিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় কোনো কোনো দেশের স্বাধীনতা দান হিসেবে অর্জিত হয়েছে।
উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতা অর্জনের এই তিন পথের বাইরে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা যা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধের সমন্বয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ভারতীয় ও পাকিস্তানি জাতীয়তার বিপরীতে বাঙালির স্বতন্ত্র জাতীয় পরিচয় সংরক্ষণের যে তাগিদ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি মানসে চেতনার বিকাশ ঘটায় তাই উনিশশো ছেষট্টির ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের চেতনা বিকাশের পথে এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকরা প্রথম থেকেই বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার হরণ ও নস্যাৎ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র হিসেবে উর্দুকে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের সে অপচেষ্টা কিয়দংশে হলেও ব্যর্থ হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি প্রাধান্য পেয়ে আসছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগবিরোধী যুক্তফ্রন্টের প্রধান এজেন্ডাই ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। এজন্য যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। ১৯৫৬-এর শাসনতন্ত্রে সীমিত আকারে হলেও স্বায়ত্তশাসনের যে রূপরেখা পাওয়া যায়, ১৯৫৮-এর সামরিক শাসন ও ১৯৬২-এর প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির মৌলিক গণতন্ত্রী শাসনতন্ত্র সে সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দেয়। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রপতির শাসন পূর্বাঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠী ও পশ্চিমাঞ্চলের পাখতুন, বালুচ, সিন্ধি প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীগুলোর সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়।
১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘৬ দফা দাবি’ পেশ করেন। ৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের লাহোরে পৌঁছান এবং তার পরদিন অর্থাৎ ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে চিত্রিত করা হয়। ফলে বঙ্গবন্ধু নিজেই ৬ ফেব্রুয়ারি এই সম্মেলন বর্জন করেন। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব পেশ এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা সম্বলিত ছয় দফা কর্মসূচির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। যা সে সময়ের রাজনৈতিক অচলায়তন ভেঙে একটি নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা করেছিল।
লাহোর কনভেনশনে ৬ দফা ঘোষণার সঙ্গে তা পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থ ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের শক্তির কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে। আইয়ুব থেকে শুরু করে তার পা-চাটা ফকা চৌধুরী, মোনেম খাঁ, সবুর খাঁ, কাজী মাহাবুদ্দিন প্রমুখ সরকারি নেতা এবং নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, মমতাজ দৌলতানা, মাহমুদ আলী কাসুরী, জুলফিকার আলী ভুট্টো, মওদুদী ও তার তস্য পদসেবী গোলাম আযম প্রমুখ বিরোধী বাঙালি-অবাঙালি নেতা ৬ দফার বিরোধিতায় মাঠ সরগরম করে তুলল। আইয়ুব বললেন, অস্ত্রের ভাষায় ৬ দফার মোকাবিলা করা হবে। বিরোধীরা বললেন যে, এটা বিচ্ছিন্নতার এক নগ্ন দলিল। এমনকি বামনেতা মওলানা ভাসানীও ৬ দফাকে সিআইএর দক্ষিণ এশীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখলেন। তিনি ঘোষণা করলেন যে, শেখ মুজিব হচ্ছেন মার্কিনি দালাল। সরকারি ও অন্যান্য বিরোধী নেতারা তাকে ভারতীয় দালাল আখ্যা দিলেন। তারা ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফরমে থাকলেও ৬ দফার বিরোধিতায় এক সুরে কথা বলতে থাকলেন।
ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপনের পরপরই বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। এর মাধ্যমে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক ও শামসুল হকসহ ১০ জন শহীদ হয়। পূর্ব বাংলার জনগণ এই আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন জানায়। ১৯৭০ সালে এলএফও দিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৬ দফার ভিত্তিতে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে নেন। একই সঙ্গে তিনি ঊনসত্তরের ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পথ জনগণের মানস গঠনকেও আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান, যা পরবর্তী সময় বাংলাদেশ প্রশ্নের সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে জনগণকে আর দ্বিধান্বিত করেনি। একাত্তরের ৭ মার্চের পর বাংলাদেশ ডি-ফ্যাক্টো স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ও সরকার গঠনে তাই আর শেখ মুজিবকে বেশি বেগ পেতে হয়নি।
মূলতঃ ছয় দফা আন্দোলনই এক সময় স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। ছয় দফার পথ ধরেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১১ দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ সর্বোপরি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।