আগামী অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী শিক্ষা খাতে মোট ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন। গত বছরে এই বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে মোট উন্নয়ন বরাদ্দের মধ্যে ১২ হাজার ১৮ কোটি টাকা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, ১৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের এবং দুই হাজার ৮২৩ কোটি টাকা কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য। বিশেষজ্ঞরা এই বরাদ্দে সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন না।
কারণ শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের জন্য ইউনেসকোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা মনে করে যে জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। ১৯৭৩ সালের কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনও এমন প্রস্তাবই করেছিল। বঙ্গবন্ধু সরকার তখন নীতিগতভাবে সেটিকে গ্রহণ করলেও দেশের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে শিক্ষা খাতে সেই অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে চেয়েছিল। তখন বঙ্গবন্ধুর সামনে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ছিল।
সেই রাষ্ট্র গঠনের জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে গোটা জাতিকে শিক্ষিত করে তোলা ছিল অপরিহার্য। বঙ্গবন্ধু সেই অপরিহার্যতা বুঝতেনও, কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হওয়ার কারণে সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ব্যাপকতর পার্থক্য থাকায় তা তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু দলিলটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন। তত দিনে প্রাথমিক শিক্ষার পুরোপুরি জাতীয়করণ হয়েছিল।
তাঁর লক্ষ্য ছিল অচিরেই মাধ্যমিক শিক্ষাকে সরকারি করা। অন্তত দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত করে তোলার পর তাদের পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়া এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষ নাগরিক করে তোলার পরিকল্পনা তাঁর ছিল। কারিগরি-পেশাগত, বিজ্ঞান ও গবেষণা শিক্ষায়ও তাঁর ছিল স্পষ্ট ধারণা। কিন্তু পঁচাত্তরের পর সেসব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নাজিল হয়েছিল অনেক আরোপিত ধারা, যেগুলোর সঙ্গে কর্মদক্ষতা, সৃজনশীল চিন্তা, উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ মোটেও সম্পর্কিত নয়।
বাংলাদেশি শিক্ষাব্যবস্থা নানা ধারা-উপধারায় যখন প্রবাহিত হতে থাকে, তখন এটিকে আর জাতীয় কোনো শিক্ষাব্যবস্থা বলা যায় না। সরকারগুলো শিক্ষা খাতে অনেকটা থোক বরাদ্দের মতো একটা অঙ্কের টাকা বাজেটে রাখত। তবে বিদেশি বেশ কিছু অর্থ দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় খাতে ব্যয়ের একটা ধারা চলে এসেছিল, যার সঙ্গে আমলাতন্ত্র গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছিল।
এগুলোর পাশাপাশি দেশে বিভিন্ন এনজিও শিশু ও কিশোরদের শিক্ষার জন্য দেশব্যাপী কিছু প্রতিষ্ঠান অস্থায়ীভাবে গড়ে তুলেছিল, যেগুলো হতদরিদ্রদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আমাদের দুটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন এসব আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে মূলধারার সঙ্গে যুক্ত করতে পারেনি। সেই চেষ্টাও হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষানীতির যেমন অনুপস্থিতি ছিল, তেমনি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক পরিচালনা পরিষদ ইত্যাদি নিয়েও কোনো মানসম্মত নিয়ম, শৃঙ্খলা কার্যকর করা যায়নি। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে অনিয়ম, অদক্ষতা, অযোগ্যতা, বিশৃঙ্খলা ব্যাপকভাবে বাসা বেঁধেছিল। শিক্ষার প্রতি আমাদের রাষ্ট্রের গুরুত্ব প্রদানের বিষয়টি দীর্ঘদিন অবহেলিত ও উপেক্ষিত ছিল।
সবারই মনে থাকার কথা সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক, কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের নানা সমিতির ব্যানারে বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন প্রতিবছর করতে দেখা গেছে। কখনো কখনো শিক্ষকদের দাবির মুখে কিছু ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে শিক্ষকতা পেশাটি মেধাবীদের কাছ থেকে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে মেধাবীদের তৈরি করাও দায়বদ্ধতার বাইরে চলে যায়। ১৯৯৬ সালের পর সরকারি ও বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা সরকারের কৃপায় পড়লেও দেশের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি শিক্ষাব্যবস্থাকে চরম নৈরাজ্যের মধ্যে রেখে দেয়। দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো ম্যাপিং নীতি গৃহীত হয়নি। কোথায় কয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, সেটি আমলারাও জানতেন না, সরকারেরও চিন্তার ধারেকাছে ছিল না। কিন্তু শিক্ষার চাহিদা তো ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়েই চলছিল। যাঁরা বিত্তশালী, তাঁরা সন্তানদের বিদেশে লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাঁরা পাঠাননি, তাঁরা খুঁজে খুঁজে নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁদের সন্তানদের উচ্চ বেতন ও শিক্ষা ব্যয়ে পড়িয়েছেন। গোটা রাজধানী ঢাকা শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কত, তা কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া যায় এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হবে না। অনেক প্রতিষ্ঠান নামিদামি বলে হাঁকডাক আছে। প্রচুর অর্থ আদায় করে নিচ্ছে, কিন্তু কোচিং ব্যবসা আর গাইড বইয়ের সীমাবদ্ধ লেখাপড়া ছাড়া সেগুলোতে প্রকৃত শিক্ষার তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশের অন্যত্র অবস্থা শোচনীয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন এমন সব অনিয়ম করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
কেজি স্কুল, ব্যক্তিমালিকানাধীন স্কুল ও কলেজ মূলধারার সঙ্গে মিল না রেখেই চলে। দেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল এবং ইংলিশ ভার্সন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত বেড়ে উঠেছে। এত বাড়বাড়ন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তহীনভাবে, এমনকি গ্রাম পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ একসময় খুব একটা আলোচনার বিষয় ছিল। কিন্তু এমপিওভুক্তি ও সরকারি অনুদান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা দিয়ে অপেক্ষাকৃত অদক্ষ ও অযোগ্য শিক্ষক বেশিসংখ্যক নিয়োগ পেয়ে বসে আছে। স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় এখন মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা খুব সীমিত পর্যায়ে চলে গেছে।
অভিভাবকদের একটি বড় অংশ লেখাপড়ার বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞাত না। আরেকটি অংশ সুবিধামতো জায়গায় সন্তানদের নিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটা বড় ধরনের অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার বেশির ভাগ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। কম্পিউটার ল্যাব, ইন্টারনেট ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এমনকি শিক্ষক নিয়োগেরও ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এসব ল্যাব পরিচালনার জন্য দক্ষ শিক্ষক ও ল্যাব সহকারী নেই। শেখ হাসিনা সরকার প্রায় ২৫ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করেছে। প্রতিটি উপজেলায় স্কুল ও কলেজ সরকারি করেছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত কলেজগুলোতে অনার্স, মাস্টার্স প্রগ্রাম এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশে ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেকগুলোতেই কাম্যসংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থী নেই। মাধ্যমিক স্কুল-কলেজের ক্ষেত্রেও আগের অবস্থার মধ্যে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। সরকারের শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপজেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর কেউ কেউ ছড়ি ঘোরান, কিন্তু দায়িত্ব পালনে মোটেও সচেতন নন। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে যে একটা বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি ও ওলটপালট ঘটে গেছে, সেটা যতক্ষণ পর্যন্ত সিরিয়াসলি নেওয়া না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য যে স্মার্ট নাগরিক গড়ে তোলা দরকার, সেটা অর্জিত হবে না। এখানে যে বিষয়টি দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরুরি বিবেচনায় নেওয়া দরকার তা হলো, কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাম্যসংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থী নেই তার প্রকৃত চিত্র দ্রুত হাতে নেওয়া। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থী নেই। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ কিংবা প্রধান শিক্ষক বা সহকারী শিক্ষক মাসে কত টাকা ঘরে বসে বসে সরকারি কোষাগার থেকে তুলে চলছেন, সেই হিসাবটা নেওয়া দরকার। এই অব্যবস্থাপনা তো চলতে দেওয়া উচিত না।
আমাদের অঢেল অর্থ নেই, কিন্তু অর্থের অপচয় কিংবা বেকার মানুষকে প্রতিপালন করার দায়িত্ব আমাদের নেওয়ার কথা নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত সরকারি-বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষার্থীবিহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বিধি মোতাবেক বদলির নিয়ম করা। সে ব্যবস্থা করলে বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আপনাতেই ঝরে যাবে। আবার যেখানে শিক্ষার্থী বেশি, সেখানেই শিক্ষকদের নিয়ে আসা প্রয়োজন। নতুন শিক্ষক নিয়োগের আগে শিক্ষাব্যবস্থার সর্বশেষ চালচিত্রটা সরকারের হাতে আসা উচিত। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণই যথেষ্ট নয়, তাঁদের পাঠদানের দক্ষতার ওপর ইনক্রিমেন্ট এবং পদোন্নতির বিষয়টাও যুক্ত করা উচিত। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক দিবস পালনের জন্য নির্দেশ দিয়ে থাকে। বেশির ভাগই মানহীন দায়সারা গোছে হয়। আবার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ওই সব দিবস পালনে মোটেও আগ্রহী নন। শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করার মতো পড়াশোনা করতেও তাদের আগ্রহ নেই। এমন রূঢ় বাস্তবতা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাজ করছে। এসব অব্যবস্থাপনার পরিবর্তন ঘটিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক মানসম্মত, বিজ্ঞানভিত্তিক, সমাজ সচেতন নাগরিক তৈরিতে শিক্ষা বরাদ্দ প্রতিবছর দ্রুত বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত মানে উন্নীত করা মোটেও অসম্ভব নয়। অপচয় বাদ দিয়ে শিক্ষায় বরাদ্দ দিয়ে মেধাবী ও যোগ্যদের শিক্ষায় আসার সুযোগ করে দিলেই স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে, অন্যথা নয়।
লেখক : ইউজিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফেলো ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়